মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ও টাকা পাচারের মুলহোতা টিটোর সম্পদের পাহাড়

দেশ থেকে পাচার করা হয় এক হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। আর চোরাচালানের টাকায় স্ত্রী, সন্তান ও নিজ নামে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। এ ঘটনার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হলেন মিরর ডেভেলপমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিদারুল আলম টিটো।

মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ও টাকা পাচারের মুলহোতা টিটোর সম্পদের পাহাড়
ছবি - অনলাইন হতে সংগৃহীত
মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ও টাকা পাচারের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে টিটো প্রথমে খোরশেদ নামের এক ব্যক্তিকে নিজের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়।
শাহাদাত হোসেন রিটনঃ
আমদানি ঠিকই করেন কিন্তু সমস্যা বাঁধল কোথায়? গোয়েন্দাদের তৎপতরতায় বেরিয়ে এলো সেই তথ্য। রাজধানীর অনেক প্রতিষ্ঠানের চিত্র ঠিক এই ঘটনার কাছাকাছি। কেউ হয়তো এখনো নজরে আসেনি আর কারো বিষয়ে এখন সন্মুখে। ঢাকার একব্যবসায়ী আছেন যিনি  বিদেশ হতে কসমেটিকস আনেন দশ কার্টুন আর নিজ অফিসের টেবিলের নিচে বালতি রেখে হুবহু কপি করেন হাজার কার্টুন।
 
এভাবে সরকারের রাজস্ব মেরে দিয়ে তিনি গাড়ি বাড়ি লিড করেন। আবার যা আনবেন বলে ঘোষনা দেন তা না এনে নিজ প্রতিনিধির কাছেই এলসি খুলে দশভাগের একভাগ কমমূল্যের জিনিস এনে বাকী টাকা পাচার করেন আরেক চক্র।  এমনই একটি প্রতিষ্ঠানের মূল হোতা টিটো। তিনি নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) অন্য আরেক ব্যক্তির ছবি, নাম-স্বাক্ষর বসিয়ে প্রথমে ব্যাংক হিসাব খোলেন এক ব্যবসায়ী। পরে সেই ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে চীন থেকে পোলট্রি শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলেন।
তবে তা না এনে মূলধনি যন্ত্রপাতির বদলে দেশে আসে মদ, সিগারেট ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী। এই কায়দায় দেশ থেকে পাচার করা হয় এক হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। আর চোরাচালানের টাকায় স্ত্রী, সন্তান ও নিজ নামে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। এ ঘটনার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হলেন মিরর ডেভেলপমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিদারুল আলম টিটো।
সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন ভয়াবহ তথ্য। তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা বেনামে আরও সম্পদ আছে টিটোর। সেই সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সিআইডি পুলিশকে চিঠি দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা।
যতসম্পদ এই টিটোরঃ
 শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, স্ত্রী রেশমা দিদারের নামে ডেমরায় ৯ শতাংশ (দাগ নং-৬৮৪), ১২ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৬৮৬), ১৭ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-২০২), ৩০ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-২৭৪), দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৭৬৩), খিলগাঁও ১০ শতাংশ (দাগ নং-৬৮৬),  খিলগাঁওয়ে ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৩৩২), ১০ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৭) জমি আছে।
তাছাড়া ময়মনসিংহের ভালুকায় ৪৬২ শতাংশ জমি এবং মিরর ডেভেলপমেন্টের নামে খিলক্ষেতে ৩০ দশমিক ৩৩ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৭৭৭), ৬ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৩৮৯) জমি আছে। এছাড়া রাজধানীর বনশ্রীর সি ব্লকে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের সাততলা বাড়ি রেশমা দিদারের নামে। টিটোর নিজ নামে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ৪ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৭৬৩), ২৬ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৫৭৮), ৪১ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৫৭৮), ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৭৬৩), ১০ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৫৫১), খিলক্ষেতে ২০ দশমিক ৩৪ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৭৭৭), ।
দিদারুল আলম টিটোর মেয়ে ইশরা দিদার ঐশির নামে বাড্ডায় ২ দশমিক ৮২৫ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-১৯২০); দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ৫ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-১০৭৬), ৪ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-১০৭৬), ৩৩ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৭৬৩), খিলগাঁওয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৬৮৪), ডেমরায় ৯ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-২৭৪) জমি আছে।
আরেক মেয়ে সিদানা দিদার দিশার নামে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৫৭৮), ২৩ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৫৫১), বাড্ডায় ৪ দশমিক ১২৫ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৩৮), খিলগাঁওয়ে ২৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ (আর.এস দাগ নং-৬৯২) জমি আছে।
 
জানা গেছে, দিদারুলের নামে বাড্ডা প্রগতি সরণিতে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা মূল্যের দুই হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, বিজয়নগরের মাহতাব সেন্টারে এক কোটি টাকা মূল্যের ৮৮৮ বর্গফুটের অফিস স্পেস, রামপুরা টিভি রোডে ৭০ লাখ টাকা মূল্যের ২টি এক হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, গুলশান-২ নম্বরে তিন কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের তিন হাজার ৭২১ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, গুলশান-১ নম্বরে চার কোটি ৬০ লাখ টাকা মূল্যের তিন হাজার ২৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, , চট্টগ্রামের খুলশিতে ৬০ লাখ টাকা মূল্যের এক হাজার ৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, পাহারতলীতে ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, আগ্রাবাদে ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ৭০০ বর্গফুটের অফিস স্পেস আছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফখরুল আলম গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, টাকা পাচারের ঘটনা উদ্ধারের পর থানায় মামলা করা হয়েছে। এখন সিআইডি অধিকতর অনুসন্ধানের পর চার্জশিট দেবে, সে বিষয়ে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠান চারটি ২৯টি চালানে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এক হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা পাচার করেছে। এর মধ্যে হেনান আনহুই অ্যাগ্রো ৪৩৯ কোটি টাকা, মেসার্স অ্যাগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি ৪৩২ কোটি টাকা, হেব্রা ব্র্যাঙ্কো ২৯১ কোটি টাকা এবং চায়না বিডিএল ২৩৪ কোটি টাকা পাচার করেছে।
শুল্ক গোয়েন্দার তথ্য মতে, দিদারুল আলম টিটো, তার ভাই শহীদুল আলম ও সহযোগীরা মিলে মেসার্স অ্যাগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি, হেনান আনহুই অ্যাগ্রো এলসি, হেব্রা ব্র্যাঙ্কো এবং চায়না বিডিএল নামে চারটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান খুলে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আনে।
 
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচারের ঘটনার প্রধান মাস্টার মাইন্ড দিদারুল আলম টিটো। বাকি আসামিদের নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন তিনি। শুল্ক গোয়েন্দার হাতে আটক হয়ে জেলেবন্দি শহীদুল আলম টিটোর আপন ভাই। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ও টাকা পাচারের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে টিটো প্রথমে খোরশেদ নামের এক ব্যক্তিকে নিজের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়।
পরে সেই ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র ঘষামাজা করে আবদুল মোতালেব নামে অন্য ব্যক্তির ছবি ও স্বাক্ষরজুড়ে দিয়ে ব্যাংক হিসাব খোলেন। আবদুল মোতালেব টিটোর বন্ধু ও সহযোগী। শহীদুলকে আটক করা গেলেও টিটোর অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।
 
অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে বিজয়নগরে মাহতাব সেন্টারে (১৩ তাল, স্যুট নং-৩) মিরর ডেভেলপমেন্টের অফিসে গিয়ে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। পরে ভবনের ম্যানেজার সরদার মো. মোস্তাইম বিল্লাহর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, দীর্ঘদিন অফিসটি বন্ধ আছে। করোনার সময় অফিস বন্ধ হয়ে যায়। আর মামলার পরে এখানে কেউ আসেনি। অন্য কোথাও অফিস আছে কিনা জানি না।
 
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তসংশ্লিষ্ট শুল্ক গোয়েন্দার এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে জানান, টাকা পাচারের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়া শুল্ক গোয়েন্দা টিটোর মিরর ডেভেলপমেন্টের অফিসে তল্লাশি চালিয়ে বিভিন্ন দলিলাদি জব্দ করে। সেসব দলিলাদির মধ্যে তার স্থাবর সম্পত্তির একাংশের তথ্য পাওয়া গেছে। তার নামে-বেনামে আরও সম্পদ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেসব সম্পদের খোঁজ নিতে দুদক ও সিআইডিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সম্পদের তথ্য গোপন করে টিটো আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন কিনা তা খতিয়ে দেখতে সিআইসিকেও অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ক্রাইম ডায়রি/ক্রাইম/জনস্বার্থে-সুত্রঃ প্রতিনিধির পাঠানো রিপোর্ট ও জাতীয় গণমাধ্যম