দুদকের জালে সামরিক বাহিনীর সাবেক ১০ কর্মকর্তা
তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিপুল অঙ্কের অর্থপাচারসহ ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষগ্রহনের।

তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিপুল অঙ্কের অর্থপাচারসহ ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষগ্রহনের। এ ঘটনা আলোচনায় আসার পর দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
ক্রাইম ডায়রি ডেস্ক:
স্বৈরাচার পতনের গণআন্দোলনের মুখে পালিয়ে ভারতে যান সাবেক স্বৈরনেত্রী শেখ হাসিনা। আর দীর্ঘ দিনের শাসন করে যাওয়া আওয়ামীলীগ সরকার পরিবর্তনের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে জোরালো অভিযান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এবার তাদের অভিযানের আওতায় এসেছে সামরিক বাহিনীর সাবেক ১০ জন শীর্ষ হাই অফিসিয়াল।
তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিপুল অঙ্কের অর্থপাচারসহ ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষগ্রহনের। এ ঘটনা আলোচনায় আসার পর দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, এসব অভিযোগের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান ও তদন্ত শুরু হয়েছে। কয়েকজনের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন গণমাধ্যমক কর্মীদের বলেন, অনেক অভিযোগ এখন অনুসন্ধানের পর্যায়ে রয়েছে এবং সেগুলোর কার্যক্রম অফিসিয়ালি নিয়মমাফিক এগোচ্ছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র ও তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করছেন। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন, তাদেরকে ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদও করছেন।
কারা আছেন এই তালিকায় আসুন জেনে নেই:
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ: সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সেনাপ্রধান ছিলেন। ২০১২-১৬ মেয়াদে বিজিবির মহাপরিচালক ছিলেন। সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং হুন্ডি ও ব্যাংক চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থপাচার করে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ব্যবসা পরিচালনা ও বাড়ি কেনার অভিযোগ ওঠে। তার বিরুদ্ধে তদন্তের দায়িত্বভার পড়ছে দুদকের উপপরিচালক মো. জাকারিয়ার উপর।
বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান শেখ আব্দুল হান্নান: এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান ২০২১ সালের ১২ জুন বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। মেয়াদ শেষ হয় ২০২৪ সালের ১১ জুন। রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়, ঘুস ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার ও স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব ও ফ্ল্যাটসহ কয়েক কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তার বিরুদ্ধে চলা অনুসন্ধানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুদকের উপপরিচালক তানজীর সরকার।
মেজর জেনারেল টি এম জোবায়ের, সাবেক এনএসআই মহাপরিচালক: তার বিরুদ্ধে চাকরিতে ঘুস গ্রহণ, ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্পদ অর্জন এবং লন্ডনে অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ এবং দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান: ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ নামে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন– তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান পরিচালনার জন্য দুদকের পরিচালক আবুল হাসনাতকে প্রধান করে একটি তিন সদস্যের দল গঠন করা হয়েছে। অন্য দুই সদস্য হলেন- সহকারী পরিচালক বিষাণ ঘোষ ও উপসহকারী পরিচালক আফিয়া খাতুন।
মেজর জেনারেল (অব.) সালাউদ্দিন মিয়াজী, সাবেক সামরিক সচিব: জমি দখল করে পার্ক নির্মাণ ও দুর্নীতির মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণের অভিযোগে তাকে যশোর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বর্তমানে তিনি জামিনে মুক্ত আছেন। সালাউদ্দিন মিয়াজী ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন।
ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান হামিদুল হক: ১৯৭০ সালে কক্সবাজারে জন্মগ্রহণ করেন হামিদুল হক। সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৮৮ সালে। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৯০ সালের ২২ জুন সেনাবাহিনীর ইনফ্যান্ট্রি কোরে তিনি কমিশন পান। সবশেষ সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং সিলেটের এরিয়া কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করছে দুদক। এজন্য দুদকের উপপরিচালক আজিজুল হককে দলনেতা করে দুই সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছে। দলের অপর সদস্য হলেন মো. মিজানুর রহমান।
এসএসএফের সাবেক ডিজি মুজিবুর রহমান: ক্ষমতার পালাবদলের পর চাকরি খোয়ানো শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের অন্যতম মো. মজিবুর রহমান ও তার স্ত্রী তাসরিন মুজিবের ‘অবৈধ’ সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধানে নেমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের সম্পদ জব্দ করতে আদালতের অনুমতিও পেয়েছে দুদক। পাশাপাশি তাদের ১৬টি ব্যাংক হিসাবও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হককে দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক এমপি: মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে দুর্নীতি ও অবৈধ ব্যবসার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা রয়েছে। তিনি ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন। মাসুদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক মোহা. নূরুল হুদাকে দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছেন উপপরিচালক ওমর ফারুক ও সহকারী পরিচালক মিনহাজ বিন ইসলাম।
মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, সাবেক এনটিএমসি মহাপরিচালক: ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া জিয়াউল সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষিত কমান্ডো ও প্যারাট্রুপার ছিলেন। ২০০৯ সালে মেজর থাকাকালে তিনি র্যাব-২-এর উপঅধিনায়ক হন। ওই বছরই তিনি পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হন এবং র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের দায়িত্ব পান। র্যাবে দায়িত্ব পালনের সময় থেকেই জিয়াউল আহসান হয়ে উঠেছিলেন সংবাদমাধ্যমে পরিচিত নাম।
কর্নেল পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক করে তাকে র্যাবেই রেখে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে জিয়াউল আহসানকে পাঠানো হয় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) পরিচালকের দায়িত্বে। ৪০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৩৪২ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে দুদক তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে। বিদেশে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকার প্রমাণও মিলেছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
বিজিবির সাবেক ডিজি সাফিনুল: বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুদক।
দৈনিক ক্রাইম ডায়রি/ ক্রাইম// সুত্র:যুগান্তর