বীমা খাতে বোবা কান্না গ্রাহকদেরঃ কৌশলে টাকা লুটপাট-প্রসঙ্গ ফারইষ্ট

লাইফ-ননলাইফ মিলিয়ে অন্তত: ২৩টি বীমা কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদ সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাত,জালিয়াতি,প্রতারণা,পুন:বীমার নামে জাল কাগজে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নেয়া এবং শত শত কোটি টাকা পাচারের (স্থানান্তর,হস্তান্তর,রূপান্তর) অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে।

বীমা খাতে বোবা কান্না গ্রাহকদেরঃ কৌশলে টাকা লুটপাট-প্রসঙ্গ ফারইষ্ট
ছবি-অনলাইন হতে সংগৃহীত
দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র জানায়,অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন বীমা কোম্পানিগুলোর দুর্নীতি,আত্মসাত এবং পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। গত ১৮ বছরে দুদকে এ সংক্রান্ত শত শত অভিযোগ জমা পড়ে। কিন্তু একটি বিভ্রান্তি এবং সীমাবদ্ধতার কারণে কমিশন এসব অভিযোগের অনুসন্ধান করতে পারেনি।
কালিমুল্লাহ দেওয়ান রাজাঃ
‘অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়’এবং জমি ক্রয়ের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দেশের বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ এবং পদস্থ কর্মকর্তারা নিজ মালিকানাধীন অন্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদানের মাধ্যমেও সরিয়ে নেয়া হচ্ছে অর্থ। গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ‘আইডিআরএ’র ভূমিকা বরাবরই সহযোগিতামূলক। বিরাট-বিপুল এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে নেই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা। উপরন্তু আইডিআরএ’র শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই চলছে দুর্নীতির অনুসন্ধান।
এ প্রেক্ষাপটে গত ৮ মার্চ দেশের বৃহৎ বীমা প্রতিষ্ঠান ‘ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি:’র পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ৭০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া এবং পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অর্থআত্মসাত এবং পাচারের অভিযোগে কোনো বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে এটিই দুদকের প্রথম মামলা। আর এই মামলার পরই আলোচনায় আসে বীমা খাতের এই অনুদঘাটিত সার্বিক দুর্নীতির বিষয়টি।

জানা গেছে, ফারইস্ট লাইফের দুর্নীতির বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে বিমা খাতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। গত ১০ বছরে ফারইস্ট লাইফে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে মূল লুটপাট হয় ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে।

এ সময়ে কোম্পানির লাইফ ফান্ড ও এফডিআর ভেঙে যুক্তরাষ্ট্রে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বহিষ্কৃত চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম। নিজের ও স্ত্রীর নামে প্রাসাদ সমান বাড়ি ও তিনটি ব্যবসা খুলেছেন। দুটি জমি ক্রয় দেখিয়ে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কিন্তু বিমার টাকা না পেয়ে প্রতিষ্ঠানটির হাজার হাজার গ্রাহক নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি লিমিটেডের গাজীপুর কলেজগেট শাখা থেকে ২০০৮ সালে একটি জীবন বীমার পলিসি করেছিলেন মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি ছয় মাস অন্তর পাঁচ হাজার ২১০ টাকা করে টানা ১২ বছরে এক লাখ ২৪ হাজার টাকার প্রিমিয়াম জমা দিয়েছেন।

গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে পলিসির মেয়াদ শেষ হলে দেলোয়ার ফারইস্ট ইসলামী ইনস্যুরেন্সের রাজধানীর দিলকুশা কার্যালয়ে যান। কম্পানিটি দেলোয়ারের প্রিমিয়ামের রসিদের সব কাগজ ও দলিলপত্র নিয়ে নেয়। বীমার পাওনা টাকা কবে মিলতে পেতে পারে এ বিষয়ে কম্পানি থেকে দেলোয়ারকে সঠিক কোনো তথ্য দেওয়া হচ্ছে না। প্রায় এক বছর আট মাস ফারইস্টের অফিস ঘুরেও এখনো টাকা পাননি তিনি। গাজীপুর এলাকায় দেড় বছর পলিসির টাকা জমা দেন দেলোয়ার। এরপর ঢাকার একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তাঁর নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি হলে পরে দিলকুশা শাখায় তিনি পলিসির অর্থ জমা দেন। করোনার কারণে কম্পানিটির ফান্ডে টাকা নেই বলে দেলোয়ারকে জানানো হয়। দিলকুশা শাখার কর্মকর্তা আকরাম হোসেন দেলোয়ারকে টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আসছেন ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে।
আকরাম হোসেন বলেন, ‘করোনার কারণে টাকা দেওয়া বন্ধ ছিল। এ ছাড়া আগের পর্ষদে দুর্নীতি হয়েছে। সরকার থেকে নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে। আশা করছি দেলোয়ারের টাকা আগামী মাস নভেম্বরের মধ্যেই দিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। ’ এরপর দেলোয়ার ফারইস্ট ইনস্যুরেন্সের একবার পল্টন, একবার দিলকুশা, আরেকবার মতিঝিল শাখায় যান। কিন্তু একেক শাখা থেকে তাঁকে একেক কথা জানানো হয়েছে। দেলোয়ারকে ফারইস্ট থেকে তিন বছরে মোট ৬০ হাজার টাকার বোনাস দেওয়া হয়েছে। বাকি আর এক টাকাও পাননি তিনি। কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে প্রিমিয়াম জমা দিয়েছি। এত দিন টাকা দেওয়ার পর ফারইস্ট আমার টাকা দিচ্ছে না। তাহলে এত দিন টাকা কেন দিলাম, কেউ আমার দায়িত্ব নিচ্ছে না। ’
দেলোয়ার হোসেনের মতো অনেক গ্রাহকের অর্থ দিচ্ছে না ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠানটির পল্টন, দিলকুশা ও মতিঝিল শাখায় গ্রাহক ভিড় করছে তাঁদের পলিসির টাকা পাওয়ার জন্য। সিলেট থেকে ঢাকায় পল্টনে এসেছেন মুজিব উদ্দিন। কম্পানিটির দ্বারে দ্বারে ঘুরেও অর্থ পাচ্ছেন না। আইডিআরএর একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কিছু করতে পারেনি বলে জানান তিনি। ‍জানা গেছে, বর্তমানে এই কম্পানির কাছে গ্রাহকের প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা দেনা আছে।কোম্পানির জমিজমা, এফডিআর আছে।
আগের পর্ষদের ঝামেলার জন্য বর্তমান কমিটি ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ভিতরের অনেকে বলছেন, ‘আগের পরিচালনা পর্ষদে দুর্নীতি হয়েছে। আইডিআরএর যথাযথ তদারকি ছিল না। আইডিআরএর সময়মতো রিপোর্ট করলে এ অবস্থা হতো না। ’ তিনি আরো বলেন, বর্তমানে জায়গাজমি বিক্রি করতেও পারছি না। এ ক্ষেত্রে আইডিআরএর সহায়তা নেই। প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে অর্থ ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। অসংখ্য দুর্নীতি হয়েছে এই কম্পানিতে, ২০১০ সাল থেকে কম্পানির অবস্থা খারাপ হয়েছে। আমি তো দায়িত্ব নিয়েই সব সমাধান করতে পারব না এই মুহূর্তে। এটার জন্য আইডিআরএর ব্যর্থতা আছে। সাবেক চেয়ারম্যান ভূমি কেনাবেচায় প্রতারণামূলকভাবে বিনিয়োগ দেখিয়ে অবৈধভাবে অর্থ আত্মসাৎ, কম্পানির ফিক্সড ডিপোজিট থেকে অর্থ আত্মসাৎ, জালজালিয়াতির মাধ্যমে বিনিয়োগ করে কম্পানির অর্থ আত্মসাৎ করে থাকলে তা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করবে কমিটি। এ ছাড়া অন্য যেকোনো ধরনের অনিয়ম খুঁজে পেলেও তা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করার কথা ছিল কমিটির।
দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র জানায়,অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন বীমা কোম্পানিগুলোর দুর্নীতি,আত্মসাত এবং পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। গত ১৮ বছরে দুদকে এ সংক্রান্ত শত শত অভিযোগ জমা পড়ে। কিন্তু একটি বিভ্রান্তি এবং সীমাবদ্ধতার কারণে কমিশন এসব অভিযোগের অনুসন্ধান করতে পারেনি। বীমা খাতকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণ্য করে বলা হতো, এ খাতের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুদক ফৌজদারি দন্ডবিধির ৪০৯ ধারা প্রয়োগ করতে পারে না। পরবর্তীতে দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বীমাখাতকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করে।
এর ফলে ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৪০৯ ধারা প্রয়োগ সংক্রান্ত বিভ্রান্তি দূর হয়। দুদক এখন দন্ডবিধির ১০৯ ধারা ৪০৯ ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন,২০১২ এর ৪(২) ধারাও প্রয়োগ করছে। এই এখতিয়ার বলেই সংস্থাটি ১৭টি বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে অন্তত: ২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগটি ৬ বছর পর পুন:অনুসন্ধান করছে। একই এখতিয়ার বলে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)র চেয়ারম্যান ড.এম. মোশাররফ হোসেনের অবৈধ শেয়ার বাণিজ্য,ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ, জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জন.অর্থ পাচার এবং তার স্ত্রী জান্নাতুল মাওয়ার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনার প্রেক্ষাপটে সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো:নূরুল হুদা অভিযোগের অনুসন্ধান চালাচ্ছেন।
সূত্রটি জানায়, ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে আলোচিত ফারইস্ট ইসলামী লাইফ কোম্পানি লি:র ৭০ কোটি টাকা লোপাট ও মানিলন্ডারিংয়ের মামলা করলেও একই প্রতিষ্ঠানের বিদায়ী পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের বিরুদ্ধে আরও অন্তত ১১টি মামলার তথ্য-প্রমাণ দুদকের হাতে রয়েছে। এছাড়া লাইফ-ননলাইফ মিলিয়ে অন্তত: ২৩টি বীমা কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদ সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাত,জালিয়াতি,প্রতারণা,পুন:বীমার নামে জাল কাগজে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নেয়া এবং শত শত কোটি টাকা পাচারের (স্থানান্তর,হস্তান্তর,রূপান্তর) অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে।
এর মধ্যে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি:, পুপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি: প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, স্ট্যান্ডার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, প্রাইম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এবং মেঘনা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি রয়েছে।
এর আগে অবশ্য ২০১৮ সালের ডিসেম্বর ১৬টি বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয় আইডিআরকে চিঠি দেয়। মন্ত্রণালয়ের তৎকালিন উপ-সচিব মো: সাঈদ কুতুব স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯-২০১৫ পর্যন্ত জীবন বীমা আইন ২০১০-এর ৬২ ধারা এবং জীবন বীমা বিধিমালা ১৯৫৮-এর ৩৯ বিধির ব্যত্যয় ঘটিয়ে ১৬টি বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি অনুমোদিত ব্যয়সীমার চেয়ে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় করেছে। এ অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিষয়ে বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।
এর আগে দুদকের এক অনুসন্ধানেই বেরিয় আসে, ২০০৯-১৫ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় খাতে ১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা আইনি সীমার অতিরিক্ত খরচ করেছে। এর মধ্যে-পদ্মা ইসলামী লাইফ ১৬৬ কোটি ৮৩ লাখ, প্রগতি লাইফ ১৪৬ কোটি ৯৬ লাখ, সানফ্লাওয়ার লাইফ ৮৬ কোটি ১৮ লাখ, মেঘনা লাইফ ৮৩ কোটি ৯৪ লাখ, ন্যাশনাল লাইফ ২১ কোটি ৩৭ লাখ, গোল্ডেন লাইফ ১৫৬ কোটি ২৫ লাখ, বায়রা লাইফ ৩৮ কোটি ৬৫ লাখ, সন্ধানী লাইফ ১৫৫ কোটি ৫৯ লাখ, প্রোগ্রেসিভ লাইফ ৩৯ কোটি ৪৪ লাখ, পপুলার লাইফ ২৮৩ কোটি ৩৮ লাখ, সানলাইফ ৮৪ কোটি ১৩ লাখ, হোমল্যান্ড লাইফ ৪৬ কোটি ৯৫ লাখ, প্রাইম ইসলামী লাইফ ৭১ কোটি ৭৯ লাখ, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ২০০ কোটি ৫১ লাখ, রূপালী লাইফ ৪৪ কোটি ৪০ লাখ এবং ডেল্টা লাইফ ৫৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা আইনি সীমার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় করেছে। কিন্তু দুদকের এখতিয়ার না থাকায় তখন অভিযোগগুলো যথাযথ ব্যবস্থা নিতে উল্টো অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আইডিআরএ’র কাছেই ফেরত পাঠায়। কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি-জানার জন্য নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ড.এম. মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগর চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেন নি। তবে জানা গেছে, আইডিআর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ওই অভিযোগ সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এ প্রেক্ষাপটে অভিযোগগুলো নিয়ে দুদক নতুন করে কাজ করছে।
অনুসন্ধান সংশ্লিষ্টরা জানান, বীমা খাতের দুর্নীতির এই জায়গাটিতে ইতিপূর্বে কোনো হাত পড়েনি। ১৯৫৮সালের বীমা বিধিমালা ৩৯ বিধির হরদম লঙ্ঘন করা হলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অর্থ আত্মসাত ও পাচারের ক্ষেত্রে এক ধরণের ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) ভোট কওে বীমার দুর্নীতিবাজরা। অনেকটা নির্ভয়ে এবং বেপরোয়াভাবেই এখাতে সংঘটিত হয়েছে দুর্নীতি। নানা অজুহাতে কোম্পানিগুলোতে অর্থের হরিলুট হয়েছে। কোম্পানির পরিচালকগণই ইচ্ছে মতো অর্থ হাতিয়েছেন।
লুণ্ঠিত অর্থের অঙ্ক অবিশ্বাস্য পরিমাণ। ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি:’র ২টি মামলায় দেখা গেছে, এমটিডিআর (মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিপ্ট) সঞ্চয় স্কিম করে সেটির বিপরীতে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৩শ’ ১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকা পরিচালনা পর্ষদ সদস্যগণ প্রতিষ্ঠানে ফেরতই দেন নি। নিজেদের মালিকানায় অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করেছেন তারা। সেই ঋণ পরিশোধ করেন নি। প্রায় অভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে আরও ২ ডজন বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রে। বিষ্ময়ের বিষয় হচ্ছে, বীমা কোম্পানিগুলোকে দেখভাল করার জন্য ‘আইডিআরএ’ নামের একটি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। বীমা সংক্রান্ত দুর্নীতির সঙ্গে এ প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কিছু অডিট ফার্ম ফরফায়েসী অডিট রিপোর্ট দিয়ে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতে সহযোগিতা করেছে।
অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠানের নামে কম দামে জমি কিনে বেশি দাম দেখিয়েও অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে পরিচালনা পর্ষদ। এটিও দুর্নীতির বড় খাত। ভুয়া কাগজপত্র সৃষ্টি করে পুন:বীমার বিপরীতে সরকারি অর্থও হাতিয়ে নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। বার্ষিক প্রতিবেদনে ‘অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়’র আড়ালে চাপা দেয়া হয় হাতিয়ে নেয়া অর্থ। ভুয়া বিল ভাউচার দাখিলের মাধ্যমে অনেক বীমার পদস্থ কর্মকর্তারাও হাতিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে বীমা কোম্পানির সঞ্চিত অর্থের বিপরীতে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাত করা হচ্ছে অর্থ। এ অভিযোগে অন্তত ১১টি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক।
এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন,বীমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। কিন্তু এখাত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা নেতিবাচক। প্রতারণা,আত্মসাতসহ নানা অনিয়মের কারণে মানুষ বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন এই খাতটিতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দুদক।
উল্লেখ্য যে, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড সাধারণ জীবন বীমা কোম্পানী হিসাবে ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্টিত হয়। বর্তমানে সারা বাংলাদেশে কোম্পানীটির ২৩ টি বিভাগীয় অফিস, ১০৩ টি সার্ভিস সেন্টার অফিস, ২৫২ টি জোনাল অফিস এবং ৬৩৫ টি প্রিমিয়াম সংগ্রহের অফিস রয়েছে।
ক্রাইম ডায়রি//ক্রাইম