বিএসটিআইয়ের অনুমতি ছাড়াই বাজারে সয়লাব অসংখ্য প্রসাধনী 

ভেজাল পণ্য ব্যবহারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বাজারে চলছে হাজার খানেক কিংবা তার বেশি ত্বক চর্চার পণ্য ও কালার কসমেটিকস ।

বিএসটিআইয়ের  অনুমতি ছাড়াই বাজারে সয়লাব অসংখ্য প্রসাধনী 
ছবি- অনলাইন হতে সংগৃহীত

কিন্তু নকলবাজরা লাইসেন্স করে সরকারকে রাজস্ব দিতে নারাজ।  জানা গেছে, লেড ও মার্কারিযুক্ত কিছ রং ফর্সাকারী ক্রিম নিষিদ্ধ করা ও বিক্রি বন্ধ করার ক্ষেত্রে অভিযান চালানো ও গোয়েন্দা তৎপরতায় বিএসটিআইয়ের পর্যাপ্ত জনবল পরিলক্ষিত হয় না।

আতিকুল্লাহ আরেফিন রাসেল:

 বিএসটিআইয়ের বাধ্যতামুলক তালিকায় থাকার পরেও কোন অনুমতি না নিয়েই বাজারে সয়লাব হয়ে আছে অসংখ্য প্রসাধনী।  এসব নকল কসমেটিক্সে বাজার এখন রমরমা।

হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় ব্র্যান্ড, ননব্র্যান্ড, দেশি-বিদেশি হাজারটা পণ্য। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের পাঁচশো'র বেশি প্রসাধনী সামগ্রী রয়েছে দেশের বিভিন্ন বাজারে। তবে এসবের কোনটা আসল কোনটা নকল খোদ বিক্রেতাও জানেন না অনেক সময়। এতে তারা তো প্রতারিত হচ্ছেনই আবার ভেজাল পণ্য ব্যবহারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। খোজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বাজারে চলে হাজার খানেক বেশি ত্বক চর্চার পণ্য ও কালার কসমেটিকস ।

 যেখানে এখন ক্ষতিকর বেনজোফেনন, আর্সেনিক,ক্যাডমিয়াম, রেটিনাইল পালমিটেট, মারকিউরাস ক্লোরাইড, ক্যালোমেলের মতো বেশকিছু ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার হচ্ছে হরহামেশা। বিএসটিআইতে এসব বিষয়ে মান নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা আছে।

কিন্তু নকলবাজরা লাইসেন্স করে সরকারকে রাজস্ব দিতে নারাজ।  জানা গেছে, লেড ও মার্কারিযক্ত কিছু রং ফর্সাকারী ক্রিম নিষিদ্ধ করা ও বিক্রি বন্ধ করার ক্ষেত্রে অভিযান চালানো ও গোয়েন্দা তৎপরতায় বিএসটিআইয়ের পর্যাপ্ত জনবল পরিলক্ষিত হয় না।

তাছাড়া বিএসটিআইয়ের ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হলে জেলা প্রশাসনের সহযোগীতা নিয়ে করতে হয়। সেক্ষেত্রে সময় একটা ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। দেখা যায়, যখন নকলবাজদের নিয়ে কোন সংবাদ বিএসটিআইয়ের কোন ফিল্ড অফিসার জানতে পারেন তখনই তার একশনে যাবার কোন উপায় থাকেনা। তখন প্রসিডিউর মেইনটেইন করতে গিয়ে নকলবাজরা সতর্ক হয়ে যায়। এসব বিষয়ে বিএসটিআইয়ের মান উইংয়ের একাধিক পরিচালক, ফিল্ড অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘প্রসাধনীর বাজার দ্রুত বড় হচ্ছে।সেখানে আমাদের অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মান প্রণয়নের পাশাপাশি প্রসাধনীর মতো পণ্যগুলো নিয়ে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত, সেটা হয়তো হচ্ছে না। তবে এটা তদারকির বাইরে নেই এমনটি নয়। তারা বলেন, ‘এ স্ট্যান্ডার্ড তৈরিও সময়সাপেক্ষ ও কমিটির মাধ্যমে অনুমোদনের বিষয় রয়েছে।

যদি কোনো প্রসাধনীর বৈশ্বিক মান নির্ধারিত না থাকে বা কোনো দেশে স্ট্যান্ডার্ড না থাকে তাহলে সেটা আরও দেরি হয়।‘নিম্নমানের প্রসাধনীতে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার হয়। এগুলো নীরবে আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে এবং আমাদের জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। জানা গেছে মাত্রাতিরিক্ত প্যারাবেন নামক একটি কেমিক্যাল ব্যবহারে ক্যান্সারে উচ্চঝুঁকি রয়েছে।

তারপরও সম্প্রতি টুথপেস্ট, হ্যান্ডওয়াশের মতো নিত্যব্যবহার্য পণ্য এবং নিম্নমান ও নকল পণ্যের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত প্যারাবেন পাওয়া গেছে একগবেষণায়। কিছদিন আগে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক গবেষণায় প্রসাধনীতে বিপজ্জনক মাত্রায় প্যারাবেন পাওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। সংস্থাটি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান ওনজিন ইনস্টিটিউট ফর অকপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথের  দেশীয় বাজারে ভেজাল তবে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই বিএসটিআইয়ের কাছে এমনটাই সংশ্লিষ্ট সত্রগুলো হতে জানা যায়। এসডো ওই গবেষণায় যেসব ব্র্যান্ডের পণ্যের নমনা পরীক্ষা করেছিল সেগুলোর প্রায় সবগুলো নামিদামি ব্র্যান্ডের।

তবে এর চেয়ে বেশি ঝুঁকিপর্ণ দেশে সয়লাব হওয়া নকল ও নিম্নমানের নিত্যব্যবহার্য পণ্য। ওই গবেষণার পর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা অথবা বিদেশ থেকে পণ্য পরীক্ষা কিংবা প্যারাবেনসহ অন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক মাত্রা বেঁধে দিতে দেখা যায়নি বিএসটিআইকে। এরই প্রেক্ষিতে বিএসটিআইয়ে মান উইংয়ের পরিচালক জনাব সাইদুল ইসলাম এর নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বিএসটিআইয়ে প্যারাবেন এর মান পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে।  তবে বাস্তবতা হলো বিএসটিআই প্রতিনিয়ত তাদের স্ট্যান্ডার্ডকে আপডেট করছে। কিন্ত আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এটা অনেক কঠিন একটা কাজ। প্যারাবেন হলো প্রিজারভেটিভের মতো এক ধরনের রাসায়নিক, যা সাধারণত প্রসাধনী, পার্সোনাল কেয়ার প্রোডাক্ট এবং ঔষুধপত্রের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।

প্যারাবেন কম ব্যয়বহুল এবং সহজলভ্য হওয়ায় উৎপাদনকারীরা এটি বেশি পরিমাণে ব্যবহার করেন। এসব পণ্য নিয়মিত ব্যবহারে বাড়ছে ত্বকের ক্যানসারসহ নানান রোগের ঝুঁকি। গবেষণা সংস্থা এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবল হাশেম সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিম্নমানের প্রসাধনীতে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার হয়। এগুলো নীরবে আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে এবং জীবন হুমকির মখে ঠেলে দিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ভোক্তাদের পণ্যে প্যারাবেন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নীতিনির্ধারকদের আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। এসব রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার এখন সময় এসেছে। সে আহ্বান বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জানানো হচ্ছে।’

‘বাংলাদেশের এমন কোনো কসমেটিকস পণ্য নেই, যা নকল হয় না। চকবাজার এবং এর আশেপাশের এলাকার চিপাগলিতে প্রায়ই ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে এমন পকেট প্রতিষ্ঠান ধত হয় । যেখানে বদনার নল দিয়ে ভরা হয় বিদেশী দামী ব্রান্ডের বিভিন্ন কসমেটিক্স। প্রকতপক্ষে, মোড়কজাত এসব পণ্য যখন বাংলাদেশে আসে, তখন অনেকগুলো ধাপ পার করতে হয়। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে পণ্যে আমদানিকারকের তথ্য থাকতে হবে। কিন্তু আপনারা দেখবেন বেশিরভাগ পণ্যের আমদানির তথ্য থাকে না। দৈনিক ক্রাইম ডায়রি ও গোয়েন্দা ডায়রি’র নিজস্ব অনুসন্ধানী টিমের গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ৭০ শতাংশ কসমেটিকস দেশে তৈরি বিদেশী ব্রান্ড যা নকল ও নিম্নমানের।

গোয়েন্দা ডায়রি’র অনসন্ধানে এরকম শ’খানেক (প্রায়) কারখানার সন্ধান পাওয়া  গেছে। যা পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে গোয়েন্দা ডায়রিতে প্রকাশিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, দেশে যে পরিমাণ কসমেটিকসের চাহিদা, তার ১৫ শতাংশ পরণ হচ্ছে দেশি কোম্পানির মাধ্যমে। ১৫ শতাংশ আমদানি করা হয়। বাকি ৭০ শতাংশ কসমেটিকস নকল ও নিম্নমানের ক্ষতিকারক উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে। পরান ঢাকার চকবাজার, ইসলামপর, কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা শহরে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এই ভেজাল কসমেটিকস তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে।

জনস্বাস্থ্যের জন্য এগুলো চরম ক্ষতিকর। কনজ্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনযায়ী, বাজারে প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর লেবেল ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নেই। এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৫ শতাংশ প্রসাধন পণ্যের বিএসটিআই সনদ নেই, ৭৫ শতাংশ পণ্যের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কোন ঠিকানা নেই। ইউনিলিভার, স্কয়ার টয়লেট্রিজ, কোহিনর কেমিক্যাল, লালবাগ কেমিক্যালের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি করা বড় বড় ব্র্যান্ডের পণ্য প্রকাশ্যে নকল করে বাজারজাত করছে একশ্রেণির অসাধ ব্যবসায়ী। ফলে হাত বাড়ালেই মিলছে আসলের পরিবর্তে নকল আর ভেজাল পণ্য।

যার মোড়ক বা ভেতরের পণ্য দেখে কারও বোঝার সাধ্য নেই কোনটি আসল, কোনটি নকল। আবার বিদেশি আমদানি পণ্যের মোড়কেও বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের প্রসাধনী নকল করে তা বাজারজাত হচ্ছে বড় বড় সপারশপ থেকে শুরু করে ব্র্যান্ড হাউজে। অনেক ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত মোড়ক ও কৌটায় নকল প্রসাধনী ঢকিয়েও বিμি করা হচ্ছে। ভোক্তা অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা  বলেন, ‘বাংলাদেশের এমন কোনো কসমেটিকস পণ্য নেই যা নকল হয় না। মোড়কজাত এসব পণ্য যখন বাংলাদেশে আসে, তখন অনেকগুলো ধাপ পার করতে হয়। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে পণ্যে আমদানিকারকের তথ্য থাকতে হবে। কিন্তু আপনারা দেখবেন বেশিরভাগ পণ্যের আমদানির তথ্য থাকে না।

এতে প্রমাণিত হয় এ কসমেটিকসগুলো আমদানির প্রোপার চ্যানেলে আসছে না। এগুলো অবৈধ পণ্য।’ সফিকজ্জামান আরও বলেন, ‘এছাড়া দেশের আনাচে-কানাচে এখন নকল পণ্য তৈরির কারখানা হয়েছে। যারা নামিদামি ব্র্যান্ডের পণ্য নকল করছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য যা মারাত্মক হুমকি।

এসব বিষয়ে কনজ্যমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন গন মাধ্যম কর্মীদের বলেছেন এত সমস্যার পরেও প্রসাধনীর বাজারে শঙ্খলার ক্ষেত্রে যতটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল, কখনো সরকার বা কেউ সেটা দেখায়নি।

জাতীয় মান প্রণয়নকারী ও মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর দায় বিএসটিআই এড়িয়ে যেতে পারে না। বিএসটিআই সনদ অুনমোদিত দেশে এখন কত ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী রয়েছে বাজারে এ তথ্য নেই।

তবে সংস্থাটি ধারণা করছে, সামগ্রিক উৎপাদনের ৩০ শতাংশ পণ্য বিএসটিআই মান সনদের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। এখনও দেশের ৭০ শতাংশ পণ্য মান নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বারডেম হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান বলেন, মাঠ পর্যায়ে তদারকি সংস্থার নিষ্ক্রিয়তায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করছে নিত্যব্যবহার্য পণ্যে।

ফলে একসময় মানুষ না জেনেই হরমোন, থাইরয়েড, বন্ধ্যাত্বের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্তের হারও বাড়ছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন তিনি। বিএসটিআইকে শুধু মান পরীক্ষা করেই দায় এড়ানো চলবে না পাশাপাশি তাদেরকেই নজরদারী ও নিয়মিত বাজার হতে স্যাম্পল কালেক্ট করে টেষ্টের ব্যবস্থার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক সময় বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স থাকলেও অনেক ব্যবসায়ী অধিক লাভের আশায় নকল পণ্য উৎপাদন করে থাকে।

সুতরাং পণ্য উৎপাদনের র’ ম্যাটেরিয়ালও এবং প্রসেসিং  অধিক মনিটরিং এর আওতায় আনা জরুরী বলে অনেকে মনে করছেন। তাছাড়া বিএসটিআইয়ের নিজস্ব গোয়েন্দা টিম গঠনের মাধ্যমে দ্রুত একশন নিয়ে নকল ফ্যাক্টরী বন্ধ ও আইনানুগ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

তবে জনগনের দাবী জনস্বার্থে বিএসটিআই তথ্যের ভিত্তিতে দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন ও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে এসব অবৈধ পকেট কারখানা বন্ধে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করুক এমনটাই কামনা করছে দেশের আপামর জনসাধারন।

দৈনিক ক্রাইম ডায়রি// বিএসটিআই