নকল ব্যান্ডরোলে সিগারেটঃ শীঘ্রই অভিযান চালাবে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর

রাজস্ব ফাঁকি দিতে একদল প্রতারক হুবহু নকল ব্যান্ডরোল বানিয়ে দেদারছে সিগারেট বাজারজাত করছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাষ্টমসের অভিযানে নকল ব্যান্ডরোলের দুটি বড় চালান ধরা পড়ে।

নকল ব্যান্ডরোলে সিগারেটঃ শীঘ্রই অভিযান চালাবে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর

নকল ব্যান্ডরোলের তদন্ত বিষয়ে ভ্যাট গোয়েন্দা বিভাগের ডিজি ড. মইনুল খান গনমাধ্যম কর্মীনদের বলেন, জাল ব্যান্ডরোল ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান শনাক্তে ভ্যাট গোয়েন্দা কাজ শুরু করেছে। বেশ অগ্রগতিও আছে। প্রাথমিকভাবে ঢাকাসহ সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সিগারেট ব্যান্ডরোলের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষার জন্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য সেগুলো সিআইডিতে পাঠানো হবে।

শাহাদাত হোসেন রিটনঃ

সিগারেটেও নকল বিজনেস । আগেও হয়তো কমবেশি ছিল তবে এখন এই প্রবণতা অনেক বেশি। রাজস্ব ফাঁকি দিতে একদল প্রতারক হুবহু নকল ব্যান্ডরোল বানিয়ে দেদারছে সিগারেট বাজারজাত করছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাষ্টমসের অভিযানে নকল ব্যান্ডরোলের দুটি বড় চালান ধরা পড়ে। এরপরই টনক নড়ে এনবিআরের। প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে  জাতীয় রাজস্ব বোর্ড( এনবিআর)। অবশ্য এনবিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক দূর্নীতি রোধে যথেষ্ট ভুমিকা রেখে চলেছে।  এরই ধারাবাহিকতায়  বিগত ডিসেম্বরে এক সপ্তাহের মধ্যে নকল ব্যান্ডরোলের বড় দুটি চালান চট্টগ্রাম কাস্টমস জব্দ করে। ১৪ ডিসেম্বর জব্দ চালানটি বাপ্পা এন্টারপ্রাইজের। চীন থেকে বাপ্পা এন্টারপ্রাইজ আর্ট পেপারের আড়ালে ৩ কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার পিস জাল ব্যান্ডরোল আমদানি করে।

বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম জাল ব্যান্ডরোলের ব্যবহার রোধে ভ্যাট কমিশনারদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন। সংস্থার সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উৎপাদনে থাকা সিগারেট কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের নির্দেশ দেন তিনি। একইসঙ্গে গ্রামে-গঞ্জে বিক্রি হওয়া সিগারেটের ব্যান্ডরোলের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন থেকে মুদ্রিত ব্যান্ডরোল কি না তা খোঁজ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কারা, কোথায় ও কীভাবে ব্যান্ডরোল উৎপাদন করছে সে ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলা হয়।

 

হিসাব করে দেখা গেছে, ধৃত চালান যদি খালাস হতো তবে সর্বনিম্ন ৯০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৪৩ কোটি টাকার রাজস্ব হারাত সরকার। ডিসেম্বর ২২,২০২১ইং আরাফাত এন্টারপ্রাইজ নামের অপর একটি প্রতিষ্ঠান অফসেট পেপারের (এ৪ সাইজের কাগজ) ভেতরে লুকিয়ে এক কোটি ৬২ লাখ সিগারেটের জাল ব্যান্ডরোল আনে। এ চালান খালাস হলে ৮০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাত সরকার। চালান দুটি জব্দ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম কাস্টমস জাল ব্যান্ডরোলের ব্যবহার রোধে সমন্বিত অভিযান চালানোর অনুরোধ জানিয়ে এনবিআরে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়- আমদানি নকল সিগারেট ব্যান্ডরোলের (স্ট্যাম্প) স্টক শেষ হওয়ার আগেই সব জেলার ডিলার, খুচরা বিক্রেতা ও সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানের গুদাম থেকে সিগারেটের নমুনা যাচাই করা প্রয়োজন।

এসব নমুনা সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে পাঠানো হলে জালিয়াতির সঙ্গে কোন প্রতিষ্ঠান জড়িত তা শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এছাড়া জালিয়াতি রোধে করণীয় নির্ধারণে শুল্ক গোয়েন্দা, ভাট গোয়েন্দা, সব ভ্যাট কমিশনারেটের সমন্বয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।  এনবিআর চেয়ারম্যানের নির্দেশে জাল ব্যান্ডরোলযুক্ত সিগারেট উৎপাদনকারী কারখানা খুঁজে বের করতে চলতি সপ্তাহে সব ভ্যাট কমিশনারেটকে চিঠি দেওয়া হবে। একইসঙ্গে উৎপাদনরত প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কঠোর মনিটরিং করতে নির্দেশ দেওয়া হবে। জাল ব্যান্ডরোলের ব্যবহার নিয়ে তদন্ত করছে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর। 

জাল ব্যান্ডরোলের তদন্ত সম্পর্কে ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, জাল ব্যান্ডরোল ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান শনাক্তে ভ্যাট গোয়েন্দা কাজ শুরু করেছে। বেশ অগ্রগতিও আছে। প্রাথমিকভাবে ঢাকাসহ সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সিগারেট ব্যান্ডরোলের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষার জন্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য সেগুলো সিআইডিতে পাঠানো হবে।

এ বিষয়ে সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সমন্বয়কারী শেখ শাবাব আহমেদ বলেন, শুধু নকল ব্যান্ডরোলই ব্যবহৃত হচ্ছে, তা নয়। আসল ব্যান্ডরোলও পুনর্ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসব ব্যান্ডরোল সংগ্রহ করে পুনরায় তা প্যাকেটে বসানো হচ্ছে।

এসব বন্ধের পাশাপাশি মিথ্যা ঘোষণায় বিদেশ থেকে সিগারেট আমদানি বন্ধ করতে পারলে সরকারের বাড়তি তিন হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব। সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবী তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেনা। তাই তাদের তরফ থেকে জাল ব্যান্ডরোলে ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব ব্যান্ডরোল ব্যবহারের জন্য কারা, কীভাবে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে সে ব্যাপারে জোরালো তদন্ত করা উচিত। এক্ষেত্রে এনবিআরের সমন্বিত অভিযানের বিকল্প নেই।

জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী-সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মাসিক চাহিদারভিত্তিতে নিজ নিজ ভ্যাট কমিশনারেটে ব্যান্ডরোলের আবেদন করতে হয়। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট কমিশনারেটগুলো ব্যান্ডরোল সরবরাহের জন্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনকে চিঠি দেয়। সে অনুযায়ী সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন ব্যান্ডরোল সরবরাহ করে।

প্রতিষ্ঠানগুলো স্ট্যাম্প ব্যবহারের পরিমাণের ভিত্তিতে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও সারচার্জ সরকারি কোষাগারে জমা দেয়। প্যাকেটে সঠিকভাবে ব্যান্ডরোল লাগানো হয়েছে কিনা তা সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করেন। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই কার্যক্রম মনিটরিং করা হয়। 

তবে সবার মনেই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে যে, সব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদমর্যাদার কর্মকর্তা মনিটরিং করেন তবে জাল ব্যান্ডরোল কারা ব্যবহার করছে ? তবে এসব  প্রতিষ্ঠানের বাইরেও আরও প্রতিষ্ঠান গোপনে সিগারেট উৎপাদন করছে?  জানা গেছে ,  এই খাত হতে অন্তত বাড়তি ৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় সম্ভব।

উল্লেখ্য যে বাংলাদেশে বর্তমানে ২০টি সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সচল আছে। এগুলো হলো-ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, জাপান টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো, তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো, হেরিটেজ টোব্যাকো, ব্লাক টোব্যাকো, মেঘনা টোব্যাকো, বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো, ভার্গো টোব্যাকো, বিউটি টোব্যাকো, ওয়ান সিগারেট কোম্পানি, এসএম টোব্যাকো, যমুনা টোব্যাকো, সামির টোব্যাকো, এবি টোব্যাকো, আলভী টোব্যাকো, মনমোহন টোব্যাকো, নাসির টোব্যাকো, ভারগন টোব্যাকো ও ফরিদপুর টোব্যাকো। এছাড়াও প্রায়  বিশটির মতো প্রতিষ্ঠানের সিগারেট উৎপাদন দীর্ঘদিন হলো কাগজে কলমে বন্ধ আছে।

ক্রাইম ডায়রি//ক্রাইম