উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে আমানত সংগ্রহঃ এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব গ্রেফতার

উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহ করে ব্যাংকিং কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লংঘন। এরা সমবায় হতে অনুমোদন নিয়ে সমবায়ের নির্দেশনা লংঘন করে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালায়। কিন্তু কাগজে কলমে দেখায় ইনভেস্টমেন্ট।

উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে আমানত সংগ্রহঃ এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব গ্রেফতার

তিনি ইসলাম প্রিয় সাধারনমানুষ,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের   আবেগ-অনুভূতিকে পুঁজি করে শরিয়ত সম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগের কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ এসেছে

রফিকুল ইসলাম হাওলাদারঃ

ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতি’ পুঁজি করা মূল হোতা হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া এহসান গ্রুপ কোম্পানির চেয়ারম্যান রাগীব আহসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

তিনি ইসলাম প্রিয় সাধারণ মানুষ,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের   আবেগ-অনুভূতিকে পুঁজি করে শরিয়ত সম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগের কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ এসেছে।  তিনি এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান। সেপ্টেম্বর ১০,২০২১ইং শুক্রবার বিকেলে কারওয়ান বাজার RAB মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান RAB এর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

Collection of deposits by showing greed for high profit: Chairman of Ehsan Group Ragib arrested

 প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতারকৃতরা হলেন এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান (৪১) ও তার সহযোগী মো. আবুল বাশার খানকে (৩৭)।

জানা গেছে, তার গ্রুপে ১৭ টি প্রতিষ্ঠান আছে।তিনি এই ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। তিনি আগে সরাসরি মুনাফা অর্জনের লোভ দেখালেও এখন ভোল পাল্টে কোম্পানিতে ইনভেস্ট দেখিয়ে টাকা নিচ্ছেন।  যদিও তা পুরনো বোতলে নতুন মদ ভরার মতো। মূলতঃ পাবলিক টাকা রাখছে লাভ পাবে এই আশাতেই। 

রাগীব আহসানের বিরুদ্ধে ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে RAB। তিনি লাখ টাকার বিনিয়োগে মাসিক মাত্রাতিরিক্ত টাকা প্রাপ্তির প্রলোভন দেখিয়ে ২০০৮ সালে ১০ হাজার গ্রাহককে যুক্ত করেন। এখন তার গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক। তিনি নামে বেনামে রসিদ বা রশিদ বিহীন বহু প্রতারণার স্বীকার দেশের অগনিত গ্রাহক। তিনি বহু লোককে চাকুরী দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বহু লোককে সর্ব শ্রান্ত করে পথে বসিয়েছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে RAB সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও RAB-10 এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর শাহবাগ থানার তোপখানা রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভাউচার বই ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।

তিনি বলেন, সম্প্রতি এমএলএম কোম্পানির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীদের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, পিরোজপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এই প্রতারণার ঘটনা প্রচার হলে দেশব্যাপী চাঞ্চল্য ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন। ফলে RAB ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। পরে রাজধানীর তোপখানা রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

RAB জানায়, রাগীব আহসান ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের একটি মাদরাসায় অধ্যয়ন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত হাটহাজারীর একটি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস ও ১৯৯৯ থেকে ২০০০ পর্যন্ত খুলনার একটি মাদরাসা থেকে মুফতি সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি পিরোজপুরে একটি মাদরাসায় চাকরি শুরু করেন। ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালে তিনি ইমামতির পাশাপাশি এহসান এস মাল্টিপারপাস নামে একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি করতেন। মূলত এই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে এমএলএম কোম্পানির প্রতারণা রপ্ত করেন। পরবর্তীতে নিজে ২০০৮ সালে এহসান রিয়েল এস্টেট নামে একটি এমএলএম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।

খন্দকার আল মঈন বলেন, তার এমএলএম কোম্পানিতে প্রায় ৩০০ কর্মচারী রয়েছেন। যাদেরকে কোনো বেতন দিতেন না রাগীব। কর্মচারীরা মাঠ পর্যায় থেকে বিনিয়োগকারী গ্রাহক সংগ্রহ করে থাকেন। তাদেরকে গ্রাহকের বিনিয়োগের ২০ শতাংশ অর্থপ্রাপ্তির প্রলোভন দেখানো হয়েছে। এভাবে তিনি দ্রুত গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধিতে সক্ষম হন।
তিনি কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং এই টাকা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হতো কি-না বা বিভিন্ন ইস্যুতে উসকানির কাজে ব্যবহৃত হতো কি-না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বিভিন্ন ভুক্তভোগীর তথ্য, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে আনুমানিক তিনি ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আত্মসাৎ করা টাকা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হয়েছে কি-না বা উসকানির কাজে ব্যবহৃত হতো কি-না সেটি গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখবেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু টাকার বিষয়টি জড়িত তাই এ বিষয়ে দুদক ও সিআইডি ব্যবস্থা নেবে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব আহসান জানান, তিনি ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- (১) এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, (২) এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, (৩) এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড, (৪) নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট অ্যাকাডেমি, (৫) জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদরাসা, (৬) হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), (৭) আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, (৮) পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, (৯) এহসান মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, (১০) মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, (১১) মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, (১২) এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, (১৩) এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস (১৪) ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট (১৫) এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, (১৬) এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার, এবং (১৭) এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম। ভুক্তভোগীরা দারি করেন, এইসব প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি পরিবারের সদস্য ও নিকট আত্মীয়দের নামে-বেনামে সম্পত্তি ও জায়গা জমি করেছেন।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে RAB জানায়, রাগীব তার পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত করে ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেন। তিনি উল্লেখ করেন, তার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে শ্বশুর প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি, বাবা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, ভগ্নিপতি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। এ ছাড়া রাগীব আহসানের তিন ভাইয়ের মধ্যে গ্রেপ্তার আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহ-পরিচালক, বাকি দুই ভাই প্রতিষ্ঠানের সদস্য। এভাবে তিনি ব্যাপক অনিয়ম করেছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, রাগীব আহসান হাউজিং, ল্যান্ড প্রজেক্ট, দোকান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সাধারণ গ্রাহকদের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তিনি এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে ১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তিনি বিভিন্নভাবে গ্রাহকদের প্রতারিত করতেন। এক্ষেত্রে তিনি চেক জালিয়াতি করতেন। অনেকেই পাওনা টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে প্রতারিত হন। এ ছাড়া অনেকেই ভয়ভীতি, লাঞ্চিত ও নির্যাতিত হতেন বলে ভুক্তভোগীরা জানান। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে।

ক্রাইম ডায়রি // ক্রাইম