ভূয়া অডিটে লোন পাশঃ ব্যাংক বাঁচাতে নজরদারি বৃদ্ধি দরকার

ব্যাংকগুলো যখন ঋণ আদায় করতে যায় তখন জানতে পারে মর্টগেজের পুরো দলিলই ভুয়া। এমনকি একই জমির দলিল একাধিক ব্যাংকে মর্টগেজ দেওয়া। পরে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করে ব্যাংক। এ মামলা চলে বছরের পর বছর।

ভূয়া অডিটে লোন পাশঃ ব্যাংক বাঁচাতে  নজরদারি বৃদ্ধি দরকার

সাথে আছে ব্যাংকের একদল ঘুষখোর কর্মকর্তা যারা টাকার বিনিময়ে লোন পাশ করানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন।  আবার এভাবেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একদল প্রতারক

অনলাইন ডেস্কঃ

একদল অডিটরই আছেন যাদের নিকট টাকা দিলেই মেলে ভূয়া ও নতুনভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করা অডিট রিপোর্ট। আবার কিছু পরামর্শক আছেন যারা ব্যাংকের সাথে কোন না কোন লিংকে জড়িত তাদের কাজই হলো ভূয়া লোনের জন্য পরামর্শ প্রদান করা। সাথে জড়িত থাকে একদল প্রাতিষ্ঠানিক একাউন্ট্যান্ট।

সাথে আছে ব্যাংকের একদল ঘুষখোর কর্মকর্তা যারা টাকার বিনিময়ে লোন পাশ করানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন।  আবার এভাবেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একদল প্রতারক। তাদের সহযোগিতা করছে একদল অসৎ কর্মকর্তা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্যের জমি, মর্টগেজের ভুয়া দলিল দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে  ব্যাংকগুলোকে ক্ষতির মধ্যে ফেলেছে এসব অসাধু চক্র। 

জমি বা স্থাবর সম্পত্তির ভুয়া কাগজপত্র কোনো যাচাই ছাড়াই শত শত কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে প্রতারক চক্র। একই জমির দলিল দিয়ে একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিচ্ছে অনেক প্রতারক। ঋণ নেওয়ার পর আর তা ফেরতও দিচ্ছে না।

ব্যাংকগুলো যখন ঋণ আদায় করতে যায় তখন জানতে পারে মর্টগেজের পুরো দলিলই ভুয়া। এমনকি একই জমির দলিল একাধিক ব্যাংকে মর্টগেজ দেওয়া। পরে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করে ব্যাংক। এ মামলা চলে বছরের পর বছর। কিন্তু অগ্রগতি হয় না। ব্যাংক লুটপাটের আরেক নতুন পদ্ধতি এলটিআর ঋণ। এ ঋণ নিতে কোনো ধরনের কাগজপত্র প্রয়োজন হয় না।

ফলে ঋণ নেওয়ার পর আর খুুঁজে পাওয়া যায় না গ্রহীতাকে। এ ধরনের ঋণ জালিয়াতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চেয়ে পিছিয়ে নেই বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানে বিষয়টি উঠে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মর্টগেজের জমি বা সম্পদ অডিটের মাধ্যমে সত্যতা যাচাই করে ঋণ দেওয়া উচিত। যে জমির বিপরীতে ঋণ নেওয়া হয়েছে সেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাইনবোর্ড টানানোর নিয়ম রয়েছে, যেন একই জমির দলিল দিয়ে কোনোভাবেই অন্য ব্যাংক থেকে গ্রাহক ঋণ নিতে না পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে ভুয়া দলিল, মিথ্যা সম্পদের তথ্য দেখিয়ে ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে চক্রটি। রূপালী ব্যাংকের করপোরেট শাখা থেকে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ব্যাংকের দুই পরিচালকের সহযোগিতায় ওই ঋণের মর্টগেজের কাগজপত্র থাকলেও অডিটের সময় দেখা যায়, একই জমির দলিল দিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,  মর্টগেজের জমি বা সম্পদ অডিটের মাধ্যমে সত্যতা যাচাই করে ঋণ দেওয়া উচিত। যে জমির বিপরীতে ঋণ নেওয়া হয়েছে সেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাইনবোর্ড টানানোর নিয়ম রয়েছে, যেন একই জমির দলিল দিয়ে কোনোভাবেই অন্য ব্যাংক থেকে গ্রাহক ঋণ নিতে না পারে।

সোনালী ব্যাংক থেকে অ্যাকুয়াটিক নামে আরেক প্রতিষ্ঠান প্রায় দেড়শ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর বিপরীতে যেসব দলিল জমা দেওয়া হয়েছে, ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়েছে একই জমির দলিলে অগ্রণী ব্যাংক থেকেও ঋণ নেওয়া হয়েছে। পরে দুই প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই টাকা আর ফেরত পায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সিটি ব্যাংক থেকে লাকি শিপবিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনের বিষয়টি ধরা পড়ার পর ওই ব্যাংকের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে এ ঘটনার মূল অভিযুক্ত ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিবিআই বিভাগ সুপারিশ করলেও বিআরপিডি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক পরিদর্শনে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের এসএ অয়েল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, যিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক। ওই পরিচালক আরেকটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন কোনো কাগজপত্র ছাড়াই।

পরে ওই ব্যাংকের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। ঋণখেলাপি ব্যক্তি কোনো ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবেন না এমন আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিভাগ তাকে পরিচালক পদ থেকে অপসারণ করেনি। অভিযোগ রয়েছে, ওই বিভাগের কর্মকর্তারাও এর সঙ্গে জড়িত।

বাাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ক্রাইম ডায়রিকে জানান, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক পর্ষদ নিয়োগ দেওয়ায় এ খাতে চরম অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। যারা জমির জাল দলিল তৈরি করছে তাদের ধরতে হবে।

কিন্তু দেখা যায় তারা বেশ প্রভাবশালী। আদালতে মামলা হলে অগ্রগতি হয় না। এর পেছনে দুর্নীতিবাজ ব্যাংক কর্মকর্তারা দায়ী। তারা মামলা করে দেন শুধু আইন মানতে হয় বলে। কিন্তু তারাই মূলত ঋণ আদায় করতে তারা চান না। অনেক সময় মামলা না করেও অর্থ আদায় করা সম্ভব। কিন্তু কর্মকর্তারা দুর্নীতি করার জন্য মামলা করেন। এর জন্য যে জমির বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয়, সেখানে সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখতে হবে।

প্রকল্পের খরচ কত, প্রকল্প সঠিক কি না তা নিশ্চিত হয়েই ঋণ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সন্দেহজনক ঋণগুলো নিয়ে কাজ করলে অনেক অনিয়ম ধরা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে অনিয়ম পেলে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

জালিয়াতির সিন্ডিকেট : বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনে দেখা গেছে, মতিঝিলে ব্যাংকপাড়ায় একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটে ব্যাংকের কর্মকর্তা, ভূমি, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি (রাজেসকো), অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতারাও জড়িত।

ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে রাজেসকো থেকে রেজিস্ট্রেশন পেতে হয়। দ্রুততার সঙ্গে রাজেসকো থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যাচাই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে জমা দেওয়া হয়। সরাসরি যাচাই না করেই সিন্ডিকেটের ওই ব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রতিবেদন দেয়। এই প্রতিবেদনের সঙ্গে যে জমির দলিল দেওয়া হয়, সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূমি অফিস থেকে এ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যাংকে দেয়া অডিট রিপোর্ট ও প্রতিবেদন পুরোপুরি মিথ্যা। ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা কোনো ধরনের যাচাই না করেই ব্যাংকের হাতে প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর এসব কাগজপত্র ব্যাংকে জমা দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় বা রাজনৈতিক নেতা বা আমলাদের দিয়ে তদবির করানো হয়। ফলে আবেদনের এক মাসের মধ্যেই ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়ে যায় প্রতারক চক্র।

টাকা পাওয়ার পর যখন কিস্তি দেওয়ার সময় হয়, সংর্িশ্লষ্ট ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায় ওই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই। থাকলেও একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে তা চালানো হচ্ছে। কিন্তু ছোটখাটো অফিস থাকলেও মূল হোতাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এরপর ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি মামলা করে দেওয়া হয়।

এ মামলার আর কোনো অগ্রগতি হয় না। বর্তমানে ব্যাংকের জাল-জালিয়াতির ঘটনায় লাখ লাখ মামলা রয়েছে অর্থঋণ আদালতে। ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে মামলা হয়েছে প্রায় ১২ লাখ। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে অর্ধেকেরও কম। শুধু ২০১৫ সালেই অর্থঋণ আদালতে মামলা হয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজারে বেশি। ২০১৪ সালে এক লাখ ৩ হাজার ৩৬টি, ২০১৩ সালে মামলা হয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার ৭৯৯টি।

অর্থঋণ আদালতে মামলা রয়েছে কথা হয় এমন এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমার নামে ৪০ কোটি টাকার জন্য অর্থঋণ আদালতে ৫৬টি মামলা রয়েছে। চার বছর আগে এ মামলাগুলো হয়েছে। আমি একবার হাজিরা দিয়েছি। এরপর আইনজীবী এটা দেখছেন। এখন আইনজীবীকে টাকা দিই। আর কিছু করতে হয় না। আমার ধারণা, সারা জীবনেও এ মামলা শেষ হবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি ব্যবসা করতে চাই।

এখন টাকা ফেরত দিলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই দিচ্ছি না। তবে এক সময় দিয়ে দেব।’ সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, জালিয়াতি থামাতে হলে ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের বিকল্প নেই। কীভাবে একটি দলিলের বিপরীতে একাধিক ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকে সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।

এ জন্য ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত। একই সঙ্গে যে জমির বিপরীতের ঋণ নেওয়া হয় সেখানে ব্যাংকের সাইনবোর্ড থাকা উচিত। এটা আছে। তবে চর্চাটা আরও বাড়ানো দরকার। তবে সবার আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। অন্যথায় এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তিনি বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকগুলো একটু নড়েচড়ে বসেছে।

এ ক্ষেত্রে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি ডাটাবেজের মতো মর্টগেজ, বিশেষ করে স্থাবর সম্পত্তির ওপর ডাটাবেজ তৈরি করা উচিত। এটি করা হলে একই জমির দলিল দিয়ে একাধিক ব্যাংক থেকে কেউ ঋণ নিতে পারবে না।

অডিট রিপোর্ট প্রদানকারী অডিট ফার্মগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত আইনি ব্যবস্থা নেয়াও জরুরী বলে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অতি সম্প্রতি লোন পাওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।  ভবন দেখিয়ে লোন নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোও বিভিন্ন কৌশলে ব্যাংককে ফাঁকি দিয়ে হাতিয়ে নিছে কোটি কোটি টাকা। ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা নামধারী এবং এদের দোসর দালালদের কারনে ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছে ব্যাংক। এ বিষয়ে ক্রাইম ডায়রির নিকট পর্যাপ্ত প্রমাণ, ডকুমেন্টস, অডিও রেকর্ড আছে। 

এ ছাড়া এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আইনজীবী, সার্ভেয়ার ও কর্মকর্তারা সঠিকভাবে প্রকল্প পরিদর্শন করলে এমন জালিয়াতি সম্ভব নয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যাংকের আইনজীবী বা সার্ভেয়াররা ঠিকভাবে কাজ করেন না। ফলে জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, অর্থঋণ আদালতের মামলার ক্ষেত্রে বলা যায়, বিচার দ্রুত হওয়া উচিত। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো মামলা করে পরে আর ঠিকমতো চালায় না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

ক্রাইম ডায়রি // অর্থ