গরিবের চালে চালবাজিঃঅভিযোগের তীর চেয়ারম্যান ও মেম্বরদের দিকে

গরীবের চাল আত্মসাতকারী দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষনের একটি বানীই যথেষ্ট। তিনি বলেছিলেন, "আওয়ামীলীগ হতে দূর্নীতিবাজদের বের করে দাও।" এই কথা দ্বারা তিনি দেশের নাগরিক সকল দূর্নীতিবাজকেই বুঝিয়েছেন।

গরিবের চালে চালবাজিঃঅভিযোগের তীর চেয়ারম্যান ও মেম্বরদের দিকে

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশি পরিমান আবাদি জমির মালিক, দোতলা বাসভবন ও কোটি টাকার সম্পদের মালিক, সচ্ছল ব্যবসায়ী এবং চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নিকট আত্বীয়রা পাচ্ছে  ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির’ সকল সুযোগ  সুবিধা

শাহাদাত হোসেন রিটনঃ 

কিছু কিছু ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বারদের কারসাজি এবং তাদের কালোথাবায়  ১০ টাকার চালে তেলেসমাতি শুরু হওয়ায় অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশি পরিমান আবাদি জমির মালিক, দোতলা বাসভবন ও কোটি টাকার সম্পদের মালিক, সচ্ছল ব্যবসায়ী এবং চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নিকট আত্বীয়রা পাচ্ছে  ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির’ সকল সুযোগ  সুবিধা।

হত দরিদ্র পরিবারের খাদ্য সমস্যার কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি শুরু হয়। ২০১৬ সাল থেকে ৫০ লাখ মানুষ এই সুবিধা পাচ্ছেন। মার্চ-এপ্রিল ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর এই পাঁচ মাস ১০ টাকা তথা শুভেচ্ছা মূল্যে তালিকাভুক্ত পরিবারকে মাসে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়ে থাকে।

বঙ্গকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ  অনুদানে দেয়া ১০ টাকা কেজি চাল তুলে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিক্রি করে দিচ্ছে, কেউবা পুকুরের মাছকে খাওয়াচ্ছেন।

অন্যের এনআইডি  দিয়ে তোলা হচ্ছে অন্যজনের চাল, ভূতুরে নামও ব্যবহার হচ্ছে। একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে  অনুসন্ধানে নাম টিম ক্রাইম ডায়রি।  এসময় তারা এসব ঘটনার বাস্তবতা দেখতে পায়। চিত্র মিলেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ফলে বিশাল ভর্তুকি দিলেও প্রকৃত গরিবদের কাছে যাচ্ছে না সুবিধা।

অনেকে একে ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির’ বদলে ‘মেম্বার-চেয়ারম্যানবান্ধব কর্মসূচি’ হিসেবে অভিহিত করছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চেয়ারম্যান-মেম্বাররা তালিকা করেন। সুতরাং, এ সংক্রান্ত দূর্নীতির দায়ভার তারা এড়াতে পারেন না। ভুক্তভোগী মানুষের অভিযোগ   প্রশাসনের কাছে  এলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে জানান কর্তৃপক্ষ। 

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন,  সরকারের এই অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এতে করে গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলো অভাবের সময়ে কম দামে চাল পায়। কিন্তু এতে সমস্যা সৃষ্টি করছে বিভিন্ন দুর্নীতি। খাদ্য অধিদপ্তরের এক পরিচালক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন , ২০২১ইং সালের শুরুর দিকে প্রায় সাড়ে তিন লাখের বেশি ভুয়া কার্ডধারী শনাক্ত করা হয়েছিল। এবার প্রকৃত উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়েছে। মানুষ অন্যায় অনিয়ম করে। তাই, অনিয়ম একেবারেই নেই তা বলা যাবে না। তবে অনিয়ম দুর্নীতি রোধের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে ।

খাদ্য অধিদপ্তর সুত্রে জানা গেছে , অ্যানালগ পদ্ধতি থাকায় অনেক অনিয়ম বিভিন্নভাবে হচ্ছিল। এখন ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র করা হয়েছে। এতে অনেক অনিয়ম কমেছে। তিনি বলেন, চাল বিতরণ প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করতে প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে সফটওয়্যার তৈরির কাজ এগিয়ে গেছে। এখন ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে উপকারভোগীদের তথ্য আপলোড করার মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে। এ কর্মকর্তা আরও জানান, এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে প্রকৃত উপকারভোগী আরও সুনির্দিষ্ট হবে, দূর হবে অনিয়ম।

কেইস ষ্টাডি ০১ঃ

বিতরনের জন্য নির্ধারিত ওএমএস ডিলার পয়েন্ট থেকে চাল তুলে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ করেছিল  ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলার সিংহেশ্বর বাজারে এক ডিলারের বিরুদ্ধে । স্থানীয়রা  জানায় বাজারের শহীদুল নামের এক ব্যবসায়ীর ঘরে কয়েক টন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল পাওয়া গেলে এলাকাবাসী উপজেলায় অভিযোগ করে। এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনের  কপি স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের নিকট আছে। প্রতিবেদন ও স্থানীয় ভুক্তভোগীদের তথ্য অনুযায়ী , যে ব্যক্তির ঘরে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল পাওয়া গেছে তাকে ও যারা চাল বিক্রি করেছে তাদেরও দোষী সাব্যস্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে উভয়পক্ষের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়।

 কেইস স্টাডি ০২ঃ

একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে দেখা যায়,  নাটোর জেলার বড়াইগ্রামের নগর ইউনিয়নের থানাইখাড়া গ্রামের বাসিন্দা আরিফ আলীর (৪২)। তার বাড়ি দোতলা , বাড়িসহ জমি প্রায় দশ বিঘা, স্থানীয়ভাবে বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তার বিশাল ওয়্যারহাউজসহ একাধিক ব্যবসা আছে। 

ব্যাংকে রয়েছে কোটি টাকা। তার নামেও রয়েছে ওএমএস এর ১০ টাকা কেজির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড। একই উপজেলার চান্দাই ইউনিয়নের দিয়ার গাড়ফা গ্রামের মোহাম্মদ আনোয়ারের (কার্ড নং ৩২৩) নামে নিয়মিত চাল তোলা হলেও তার নামে কোনো কার্ড হয়েছে এমনটি জানা নেই তার।

নগর ইউনিয়নের বড়দেহা গ্রামের শুকুমুদ্দিন প্রামাণিকের স্ত্রী আমেরজান বেগম (কার্ড নং ৪০৮) দুই বছর আগে মারা গেলেও চাল উঠছে তার নামে। একই গ্রামের কার্ডধারী শাহিদুল ইসলামের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন এবং রহমত আলীর ছেলে কাজল আলীর  কার্ডের কোন হদিস নেই।   ওই গ্রামের মতিউর রহমানের পুকুরসহ ১০ বিঘা জমি থাকলেও তিনি দিনমজুর পরিচয়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল তুলে পুকুরের মাছকে খাওয়াচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। 

 শুধু খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির নয়, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেসব তালিকা স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান-মেম্বাররা করেন। সেখানে সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানরাও প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের লোক ঢুকান। কিন্তু মূল দোষ পড়ে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ওপর

কেইস স্টাডি ০৩ঃ

মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বেতকা  ইউনিয়নে হতদরিদ্রদের ১০ টাকা কেজির চাল চুরি অভিযোগ উঠে ওই ইউনিয়নের ডিলার সোবহান বাগজার বিরুদ্ধে। এনিয়ে টঙ্গীবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে ভুক্তভোগীরা।

জানাগেছে, হত দরিদ্রদের জন্য বরাদ্ধকৃত ১০টাকা কেজি মূল্যের  চাল বিক্রির ডিলার সোবহান কার্ডধারীদের না দিয়ে বাহিরে বিক্রি করে দিচ্ছিলেন। এছাড়াও চাল ডিলার সোবহান একাই নিজ নামে প্রভাব খাটিয়ে বেতকা ইউনিয়নের ১০ টাকা কেজি মূল্যের হতদরিদ্রের চাল বিক্রির ডিলার এবং সরকারের ওএমএস ডিলার দুটি ডিলারের লাইসেন্স নিয়েছিলেন। পরে অভিযোগের প্রেক্ষিতে এনএসআই ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের তদন্তে বিষয়টি প্রমানিত হলে সোবহান বাগজার ডিলারশিপ বাতিল করা হয়। মন্ত্রণালয় কর্তৃক সরাসরি তদন্ত করে দ্রুত তার ডিলারশীপও বাতিল করা হয়েছে। 

কেইস স্টাডি ০৪ঃ

দিনাজপুরের বিরামপুর এলাকা। এখানেও আছে চরম অনিয়মের অভিযোগ। 

‘হামাগরে থাকবার জায়গাও নাই, তাহোও হামরা পাওছি না ১০ টাকা কেজির চাল। যার আবাদি জমি, পাকা বাড়ি আছে-ওরায় পাওছে এই চাল।’ চরম অভাবে থাকলেও সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজির চাল না পেয়ে এমনই কথা জানালেন দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার আদর্শ গুচ্ছগ্রামের আশ্রিত ৮০ বছরের বৃদ্ধ সৈয়দ আলী। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়া এই উপার্জন অক্ষম বৃদ্ধ জানালেন, বাড়ির অবস্থা যাই থাক, চেয়ারম্যান-মেম্বারের লোক হলেই পাওয়া যায় ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড। বিরামপুর উপজেলার জোতবানী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মঙ্গলপুর গ্রামের তানভীর হোসেনের রয়েছে ছয় বিঘা আবাদি জমি, আবু হোসেনের তিন বিঘা, বাবু মিয়ার তিন বিঘা, ধনসা গ্রামের আনিছুর রহমানের পাঁচ বিঘা আবাদি জমি থাকলেও প্রত্যেকেই পাচ্ছেন ১০ টাকা কেজির চাল। এদের কারও কারও আছে পাকা বাড়িও।

জানা গেছে,  শুধু খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির নয়, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেসব তালিকা স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান-মেম্বাররা করেন। সেখানে সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানরাও প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের লোক ঢুকান। কিন্তু মূল দোষ পড়ে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ওপর।

কেইস স্টাডি ০৫ঃ

হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার হাওরাঞ্চল সুজাতপুর ইউনিয়নের শতমুখা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হান্নানের স্ত্রী মমতাজ বেগম ও তার বৃদ্ধ স্বামী কোনো কাজ করতে পারেন না। কানেও ঠিকমতো শুনতে পান না। তার একমাত্র ছেলে হকার। তার সামান্য আয় থেকেই সংসার চলে। মমতাজ বেগম সাংবাদিকদের বলেন, কখনোই সরকারি বরাদ্দের চাল পাইনি। চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কাছে গেলে তারা বলেন, চাল দেয়া শেষ হয়ে গেছে। আর কত দরিদ্র হলে সরকারি চাল পাওয়া যায় জানি না।

জানা গেছে,  উপজেলা প্রশাসনের দায়িত্ব থাকলেও ইউএনওরা ব্যস্ততার কারনে দায়িত্ব দেন সংশ্লিষ্টদের। অনেক ট্যাগ অফিসার এলাকায় থাকেন না, অনেক এলাকায় প্রভাবশালী ডিলার ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বিরোধে যেতে চান না তারা। ফলে প্রকৃত উপকার ভোগীদের সুবিধা পাওয়া অনেক কঠিন। এমন দাবি করেছেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তারা। 

কিছু জায়গায় ওএমএসের কার্ড করে দেয়ার জন্য স্থানূয় মেম্বার মাতবররা ১০০ হতে ১০০০ টাকা উৎকোচ গ্রহন করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া, ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার আলমনগর মধ্যপাড়ায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৬০ বস্তা চাল জব্ধ করা হয়েছিল। গোপালপুর উপজেলার চাতুটিয়ার মধ্যপাড়ার লাল মিয়ার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৭৬ বস্তা চাল। এ ঘটনায় উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ ইবনে হুসাইন বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের ও করেছেন।

  দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন অনিয়মের খলনায়ক জনপ্রতিনিধিরা। বঙ্গবন্ধুর বজ্রবানী আওয়ামীলীগ হতে দূর্নীতিবাজদের বের করে দাও। এরই ধারাবাহিকতায় ও বঙ্গকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূর্নীতির বিরুদ্ধে আপোসহীন নীতিতে আস্থাবান সাধারন জনগন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের স্বেচ্ছাচারীতার বিরুদ্ধে স্বোচ্চার। বঙ্গকন্যার নিকট তাই চাল নিয়ে চালবাজির খলনায়কদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবেদন সাধারন মানুষের। 

 

ক্রাইম ডায়রি / তথ্যসুত্রঃ স্থানীয় প্রতিনিধি, জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন গণমাধ্যম // ক্রাইম