মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী অপকর্মের শাস্তি চান

ডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গরিব ও অসহায় মানুষকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়ে তাদের চিকিত্সার নামে হাত-পা কেটে ফেলতেন মিল্টন। মিল্টনের বিরুদ্ধে ওঠা গুরুতর সব অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে ডিবি।

মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী  অপকর্মের শাস্তি চান
ছবি-ক্রাইম ডায়রি

মিল্টনের অপকর্মের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে রোববার ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হয় তার স্ত্রীকে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুপুরে বের হওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রচলিত আইনে তার শাস্তি হবে। 

মো: হেলাল উদ্দিন:

একের পর এক থলের বেড়াল বের হয়ে আসছে মিল্টন মামলায়। ঘটনার প্রতি স্টেপ মিল্টন নিজেই স্বীকার করছে। ফলে, মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মিরপুর থানায় করা মামলায় ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’-এর চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারকে চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।  ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম শান্তা আক্তার রোববার শুনানি শেষে এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে জাল মৃত্যুসনদ তৈরির অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে করা মামলায় তিনদিনের রিমান্ড শেষে রোববার আদালতে হাজির করা হয় মিল্টনকে।   ডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গরিব ও অসহায় মানুষকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়ে তাদের চিকিত্সার নামে হাত-পা কেটে ফেলতেন মিল্টন। মিল্টনের বিরুদ্ধে ওঠা গুরুতর সব অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে ডিবি। মিল্টনের অপকর্মের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে রোববার ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হয় তার স্ত্রীকে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুপুরে বের হওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রচলিত আইনে তার শাস্তি হবে। 
মিল্টনের স্ত্রী সাংবাদিকদের যা জানালেন:

মানবসেবার আড়ালে স্বামী মিল্টন সমাদ্দারের অপকর্মের বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেছেন তার স্ত্রী মিতু হালদার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন তিনি। ছয় ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদে মিতু ডিবিকে জানান, তিনি মিল্টনের প্রতিষ্ঠানে সময় দিতেন না। তিনি তার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এছাড়া ফাউন্ডেশনের নামে যেসব অর্থ এসেছে, তার কোনো কিছুতেই তার নাম নেই। রোববার বেলা ১১টার দিকে ডিবি কার্যালয়ে আসেন মিতু হালদার। বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। এর মধ্যে তাকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি।  এরপর ডিবি কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন মিতু হালদার।  

এ সময় তিনি বলেন, স্বামীর এসব অপকর্মের বিষয়ে কিছু জানতেন না। মিল্টনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, অভিযোগ সত্য হলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হোক।  এর বাইরে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।    রাজধানীর মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে রোববার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা গরিব ও অসহায় মানুষকে তুলে এনে আশ্রয় দেওয়া হতো ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার' আশ্রমে। তাদের কারও কারও হাত-পায়ে পচনও ধরেছিল। যখন অপারেশন প্রয়োজন হতো, তখন আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার নিজে বেলেড-ছুরি দিয়ে তাদের হাত, আঙুল কেটে ফেলতেন। 

হারুন অর রশীদ বলেন, একজন চিকিত্সককে মাসিক ১২ হাজার টাকা বেতনে রেখেছিলেন মিল্টন। মাসে একবার এসে দেখে যেতেন রোগীদের। ওই চিকিত্সকের নামে সিল তৈরি করে নিজেই স্বাক্ষর করে মৃত্যুসনদ তৈরি করতেন। ওই চিকিত্সককে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তিনি জানিয়েছেন, এসবের কিছুই তিনি জানতেন না। 

হারুন অর রশীদ আরও বলেন, মিল্টন সমাদ্দারের মতো সাইকোপ্যাথিক মানুষ কীভাবে মানবতার ফেরিওয়ালা হয়? তা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি যে নির্যাতন করে বেলড-ছুরিতে নিজেই অপারেশন করতেন, টর্চার সেলে মানুষকে পেটাতেন, তাদের যে বানর বলে অভিহিত করতেন, পিটিয়ে নিস্তেজ করতেন। 

তিনি স্বীকার করেছেন, এসব করে তিনি পৈশাচিক আনন্দ পেতেন। আমরা তার টর্চার সেল থেকে আলামত জব্দ করেছি। কথিত অপারেশন থিয়েটার থেকে বে্লড ছুরি জব্দ করেছি। ডিএমপির ডিবিপ্রধান বলেন, মিল্টন সমাদ্দার ভয়াবহ অপরাধ করেছেন। একটি-দুটি অপরাধ করেননি, তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ তো ভয়াবহ। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তার অ্যাকাউন্টে এখনো ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা আছে। এত টাকা থাকার পরও তিনি কাউকে চিকিত্সা করাননি। যারা তার সঙ্গে জড়িত, যারা পেট্রোনাইজ করেছে, সহযোগিতা করেছে, ফেসবুকে ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য যারা পেট্রন করেছে, ফাউন্ডেশনের মেম্বার, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। ৯০০ লোকের মৃত্যু সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন সমাদ্দার পুলিশকে জানিয়েছেন, আসলে ৯০০ মানুষ মরেনি। ১৩৫ জন মারা গেছে। তাদের দাফন করেছে। সেটারও তিনি রেজিস্টার্ড সংগ্রহে রাখেননি। এত মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে অবশ্যই তাকে জবাব দিতে হবে।

যা করা হলো তার আশ্রমের আশ্রিতদের:

মিল্টন সমাদ্দারের ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমে থাকা ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শামসুল হক ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। এই ফাউন্ডেশন এখন থেকে মিল্টনের আশ্রমে থাকা বৃদ্ধ, অনাথ শিশু ও মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসা সেবার দায়িত্ব পালন করবে। সোমবার দুপুরে ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এ তথ্য জানান। 

তিনি বলেন, মিল্টন সমাদ্দার গ্রেফতার হয়েছেন। এসময়ে তার আশ্রমে থাকা বৃদ্ধ, অনাথ শিশু ও মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি যারা আছেন তাদের শামসুল হক ফাউন্ডেশন থেকে সব ধরনের সেবা প্রদান করা হবে। শামসুল হক ফাউন্ডেশনের কর্ণধার রোববার ডিবি কার্যালয়ে এসেছিলেন। তাকে অনুরোধ করা হয়েছে মিল্টনের আশ্রমে থাকা ব্যক্তিদের খাওয়া-দাওয়া ও চিকিৎসা সেবা দেওয়ার। তিনি তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। হারুন জানান, সেখানে সার্বক্ষণিক একজন চিকিৎসক থাকবেন। তিনি চিকিৎসা দেবেন। এতে যা খরচ হবে সেই খরচ শামসুল হক ফাউন্ডেশন থেকে ব্যয় করা হবে। তবে মিল্টনের আশ্রমেই ওই ব্যক্তিদের সেবা ও চিকিৎসা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

মানবতার ফেরিওয়ালার মুখোশের আড়ালে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার ভয়ংকর ‘সাইকোপ্যাথ’। নিজের বাবাকে পিটিয়ে এলাকা ছাড়া হয়ে ঢাকা শহরে এসে সে সাইকোপ্যাথে পরিণত হয়। (সাইকোপ্যাথি হলো এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা। এটি একটি পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার)। ফলে ভয়ংকর সব অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে সে। তার অপকর্মের অভিযোগগুলো সম্পর্কে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তার স্ত্রী মিতু হালদার ও নিয়োগ দেওয়া চিকিৎসককে ডিবিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মিল্টনকে অর্থ সহায়তাকারীদের তালিকা করে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পর্যায়ক্রমে মিল্টনের অপকর্মের সব সহযোগীকেই জিজ্ঞাসাবাদ ও আইনের আওতায় আনা হবে। এদিকে মিল্টন সমাদ্দারকে দ্বিতীয় দফায় ৪ দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে।

বুধবার (১ মে) রাতে রাজধানীর মিরপুরে অভিযান চালিয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা-মিরপুর বিভাগের একটি টিম। পরে রাতে তার বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় বিভিন্ন অভিযোগে তিনটি মামলা হয়। সেসব মামলায় মিল্টনকে ৩ দিনের রিমান্ড দেন আদালত। 

রহস্যময় মিল্টন:

রহস্যময় মিল্টন সমাদ্দারের ভয়ংকর সব অপকর্মের বিষয়ে তদন্ত করছে ডিবি মিরপুর বিভাগের একাধিক টিম। গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাকে। তবে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে জাল-জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন মিল্টন। তবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির বিষয় অস্বীকার করেছেন। শনিবার রিমান্ডের তৃতীয় দিনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্টরা। 

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মিল্টনের আশ্রমে কোনো নিবন্ধিত ডাক্তার নেই। তিনি নিজে ডাক্তার সেজেছেন। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক কিশোর বালাকে সঙ্গে নিয়ে প্রতারণামূলকভাবে আশ্রিতদের বিভিন্ন চিকিৎসা করেন, সেবা দেন, পাশাপাশি এ নিয়ে ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমোতে প্রচার করতেন। এসব ভিডিও ১ কোটি ২০ লাখ ফ্রেন্ড-ফলোয়ারের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে টাকা উপার্জন করতেন মিল্টন। 

ফের চারদিনের রিমান্ডে : আশ্রমের মৃত ব্যক্তিদের জাল মৃত্যুসনদ দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় তিনদিনের রিমান্ড শেষে রোববার মল্টিনকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
অপরদিকে তার বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে সাতদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করে পুলিশ। আদালত শুনানি শেষে তাকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এর আগে বুধবার রাতে রাজধানীর মিরপুরে অভিযান চালিয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

ক্রাইম ডায়রি// ক্রাইম