সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা ম্যাজিষ্ট্রেট পরিচয়ে অভিনব প্রতারণা: প্রতারক গ্রেফতার

নিজেকে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করে ভূয়া বিয়ের নাটক ফেঁদে মেয়েদের অশ্লীল ভিডিও সংরক্ষণ করে ব্ল্যাকমেল করতো ।

সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা ম্যাজিষ্ট্রেট  পরিচয়ে অভিনব প্রতারণা: প্রতারক গ্রেফতার
ছবি- অনলাইন হতে সংগৃহীত

ভিকটিম জেরিন বুঝতে পারে আসিফ এতদিন যা বলেছে সে আসলে সব মিত্থ্যা বলেছে, সে আসলে প্রতারকের পাল্লায়।

অনলাইন ডেস্কঃ

প্রযুক্তির সর্বাধুনিক যুগে মানুষ  এখনও যে  এতটা বোকামি করে তা সত্যিই সভ্য সমাজকে ভাবিয়ে তুলতে শুরু করেছে। যুগ ডিজিটাল হয়েছে কিন্তু মানুষ তার অন্তরে এখনও ঠিক আদিম ও প্রাকৃতিক। এই তো ক’দিন আগে ফেনীতে একজন উচ্চশিক্ষিত শিক্ষিকা একজন ফেসবুক এএসপি পরিচয়দানকারীর সাথে মাত্র ষোল দিনের সম্পর্কের মাথায়  লাখ টাকা দিয়ে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে। বার বার ঠকেও মানুষ ইকমার্সে পুনঃরায় বিনিয়োগ করে আবারও ঠকে। আবার অনলাইনে একজন বলল আমি ম্যাজিষ্ট্রেট সে বিশ্বাস করল  এবং অনলাইনে বিয়েও সেরে ফেলল। এটা কি মানুষের সরলতা না অতি লোভ তা এখন ভেবে দেখা উচিত। মানুষের মানসিকতার এই পরিবর্তনের সাথে অপরাধ ও অপরাধীর ধরনও পাল্টে গেছে।

সম্প্রতি সিআইডি’র জালে ধরা পড়েছে  এমনই একজন প্রতারক।প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রতারক মামুন এর আসল নাম মোঃ মমিনুল ইসলাম (৩০), পিতা- মোঃ আব্দুস সাত্তার, মাতা- মোছাঃ মরিয়ম, সাং- গোবিন্দপুর, থানা- খানসামা, জেলা- দিনাজপুর।

পেশায় গ্রিল ওয়ার্কশপের কর্মচারী হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে একজন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। আবার কখনও বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের সহকারী উপ সচিব, কখনও বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কখনও ব্যাংক কর্মকর্তা আবার কখনও ইঞ্জিনিয়ার। নিজেকে উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন মেয়ে ও সাধারণ লোকেদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে সুবিধাজনক স্থানে বদলী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে বিদেশ গমনসহ নানা সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেয়ার নাম করে অর্থ আত্মসাৎ করতো।

নিজের আসল পরিচয় গোপন করে সব তথ্য অবিকৃত রেখে ভ‚য়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী করতো। তবে তার বেশী আগ্রহ বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের প্রতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তার শরীরের অবয়বের সাথে মিলে যায় এমন শারীরিক গঠনের মুখে মাস্ক পরিহিত কিংবা মুখাবয়ব স্পষ্ট বোঝা যায়না এমন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময়ের ছবি নিজের ছবি হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করতো।

সম্পর্কের এক পর্যায়ে সে ভুক্তভোগী মেয়েদেরকে বিয়ের প্রস্তাব দিতো এবং ভুক্তভোগী মেয়েদেরকে খুব দ্রæতই বিয়ে করতে চায়, যদি কোন ভুক্তভোগী তার বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া না দিতো, তাহলে প্রতারক মামুন আত্মহত্যা করবে মর্মে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে মেয়েদেরকে বিয়েতে রাজি করাতো। পরে বিয়ের ফাঁদে ফেলে ভুক্তভোগী মেয়েদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্বসাৎ করতো।

সি আইডি সুত্রে জানা গেছে, জেরিন তাসনিম(ছদ্মনাম) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকার একটি কলেজে অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে, মধ্যবিত্ত পরিবারের দুই ভাইবোনের মধ্যে জেরিন বড়, ছোট ভাই উচ্চমাধ্যমিক এ পড়ছে।  জেরিন চঞ্চল হাসিখুশি আধুনিক একটা মেয়ে। ফেইসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় প্রতারকের সঙ্গে।

 জেরিন দেখে ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছে আসিফ আহমেদ(ছদ্মনাম) নাম একজন ব্যক্তি, কৌতূহলবশত আসিফ এর প্রোফাইলে জেরিন ঢুকে দেখে আসিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কিছুদিন আগে নিয়োগ পেয়েছে, বর্তমানে সে তার কর্মস্থল চুয়াডাঙ্গাতে অবস্থান করছে, জেরিন তেমন কিছু না ভেবেই যেহেতু প্রোফাইল দেখে মনে হচ্ছে ভালো অবস্থান, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করলো। ধীরে ধীরে আসিফ এর সাথে চ্যাট শুরু হলো, তারপর একদিন আসিফ ওর মোবাইল নম্বর নিয়ে মোবাইলে কথা বললো,আসিফ এর আকর্ষণীয় ভয়েস, ব্যাক্তিত্ব সব মিলিয়ে জেরিনের ও আসিফকে খুব ভালো লাগে, দুজনের অনুভূতি আদানপ্রদানের মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে, আসিফ এর সাথে জেরিনের যা কথা হতো সব ফেসবুক আর মোবাইলেই সীমাবদ্ধ ছিল, সামনে কখনোই জেরিন দেখেনি আসিফকে, মাঝে মাঝে অফিসিয়াল দায়িত্ব পালনের ছবি দিতো যেখানে দূর থেকে মাস্ক পড়া আসিফ দায়িত্ব পালন করছে।

সম্পর্কের পাঁচ মাস পর আসিফ জেরিনকে বিবাহ প্রস্তাব দেয়, এখনই পারিবারিকভাবে জানাবেনা কিছু বললো আসিফ কারণ তার বড় ভাই এর বিয়ে কিছুদিন পর, এখন আপাতত নিজেরা বিয়ে করে রাখবে পরে সময় হলে পরিবারকে জানাবে একথা বললো আসিফ। জেরিন সরল বিশ্বাসে আসিফ এর কথা মেনে নিলো , বিয়ের দিন আসিফ জানালো ওর হঠাৎ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে রাজশাহী যেতে হচ্ছে তাই আসিফ ঢাকায় আসতে পারছেনা তবে আসিফ সব রেডি করে রেখেছে, আসিফ নিকাহনামা কুরিয়ার এ পাঠালো আর জেরিনকে বললো নিজ স্বাক্ষর দিয়ে কুরিয়ারে যাতে পাঠিয়ে দেয় , জেরিন উক্ত কাবিননামায় স্বাক্ষর করে পাঠিয়ে দেয় ।

বিবাহ সম্পন্নের পর আসিফ জেরিনকে আপত্তিকর ও অশালীন ভাবে ভিডিও কল এ আসতে বলতো, আপত্তিকর অবস্থায় কথোপকথনের সময় আসিফ স্ক্রিন রেকর্ডারের মাধ্যমে সেই ভিডিওগুলো নিজ মোবাইলে সংরক্ষণ করতো, কিছুদিন পর বের হলো আসিফ এর আসল রূপ, উক্ত ভিডিওগুলো অনলাইনে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দিবে যদি জেরিন তাকে টাকা না দেয় এসব বলে নানা হুমকি ও মানসিক নির্যাতন করে অনেক টাকা আত্মসাৎ করে জেরিন এর কাছ থেকে, ভিকটিম জেরিন বুঝতে পারে আসিফ এতদিন যা বলেছে সে আসলে সব মিত্থ্যা বলেছে, সে আসলে প্রতারকের পাল্লায় পড়েছে ।

জেরিন প্রতারক আসিফ অরফে প্রতারক মামুনের বিরুদ্ধে থানায় পর্নোগ্রাফি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনা মামলা করে ডিএমপির পল্টন থানায়।    সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের সাইবার ইনভেস্টিগেশন ও অপারেশনস টিম মামলাটির তদন্ত ভার পাওয়ার পর প্রতারক মামুনকে সনাক্তপূর্বক গ্রেফতার করার জন্য কার্যক্রম শুরু করে। ব্যাপক প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের পর প্রতারককে সনাক্ত করতে সক্ষম হয় সিআইডির সাইবার ইনভেস্টিগেশন এন্ড অপারেশনস টিম।

পরবর্তীতে সিআইডির সাইবার পুলিশের একটি চৌকষ টিম তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় অভিযান পরিচালনা করে  প্রতারক মামুনকে শনাক্ত করে এবং দিনাজপুর এর খানসামা থানাধীন আমতলী বাজার থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। গ্রেফতারকালীন প্রতারক আসিফের কাছ থেকে ০৫টি নিকাহনামা , মোঃ আসিফ আহমেদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এর বদলির ভুয়া অফিস আদেশের কপি ও প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ০২টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয় ।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, আসিফ আহমেদ অষ্টম শ্রেণী পাশ, গ্রিল এর ওয়ার্কশপের কর্মচারী হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কখনো সে হয়ে যায় সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট , কখনো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী উপ সচিব , কখনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা , কখনো ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা, কখনো ইঞ্জিনিয়ার। নিজেকে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করে ভূয়া বিয়ের নাটক ফেঁদে মেয়েদের অশ্লীল ভিডিও সংরক্ষণ করে ব্ল্যাকমেল করতো ।

 সি আইডি সুত্রে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার শারীরিক অবয়বের সাথে মিলে যায় এমন সরকারি কর্মকর্তার মাস্ক পরিহিত ছবি নিজের ছবি বলে দাবি করে মেয়েদের ধোঁকা দিতো, এ পর্যন্ত আসিফ প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে দশ জন মেয়েকে বিয়ে করেছে এবং ব্ল্যাকমেইলিং করে বিপুল টাকা আত্মসাৎ করেছে , আসিফ এর মোবাইল ডিভাইসে ৫০ এর অধিক মেয়ের সাথে ভিডিও কলে কথোপকথন ও অসংখ্য ন্যুড ভিডিও পাওয়া যায় । তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।

ক্রাইম ডায়রি//ক্রাইম