শেয়ারের নামে উচ্চসুদে ব্যাংকিং কার্যক্রমঃ নড়ে বসেছে ফিন্যান্সিয়াল গোয়েন্দারা

সমবায়ের অনুমতি নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো আইন বহির্ভূত। শেয়ারের নামে উচ্চসুদে হয় আমানত সংগ্রহ।

শেয়ারের নামে উচ্চসুদে ব্যাংকিং কার্যক্রমঃ নড়ে বসেছে ফিন্যান্সিয়াল গোয়েন্দারা

  এসংক্রান্ত গোটা বিশেক প্রতিষ্ঠানের পুরো তথ্য প্রমাণ এখন টিম ক্রাইম ডায়রির হাতে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা,বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক,ডিসি অফিসের কর্মচারী, প্রশাসনের অনেক সাবেক ও চলমান কর্মকর্তাসহ অসংখ্য বিনিয়োগকারী আছে যাদের অর্থের উৎস অজ্ঞাত।

(ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ২য় অংশ)

আতিকুল্লাহ আরেফিন রাসেলঃ

উচ্চসুদে শেয়ারের নামে আমানত সংগ্রহ বিনিময়ে শেয়ার হোল্ডার বা পরিচালক কিংবা বিনিয়োগকারী নাম দিয়ে সুদের লভ্যাংশ প্রদান করে ব্যাংক না হয়েও ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবশেষে নড়েচড়ে বসেছে গোয়েন্দারা। শতকোটি টাকা লস থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকেরা কিন্তু নামীদামী গাড়ি হাঁকান কিংবা বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। টিম ক্রাইম ডায়রির ধারাবাহিক ও গভীর অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শতাধিক আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া গেছে। যেসবের উপযুক্ত প্রমান, রেকডিং,ভিডিও অডিও, দলীলদস্তাবেজ টিম ক্রাইম ডায়রির হাতে এসে পৌঁছেছে। ইতোপূর্বে, ক্রাইম ডায়রিতে এসংক্রান্ত নিউজের প্রথমপর্ব প্রকাশিত হলে অর্থনৈতিক গোয়েন্দাদের নজরে আসে বিষয়টি। এরপর বিষয়টি তারা আমলে নিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে অনুসন্ধানে নামে। 

সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণা চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ  পাওয়া গেছে " স্মল ট্রেডার্স কো-অপারেটিভ" (এসটিসি) ব্যাংক লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। 

টিম ক্রাইম ডায়রির অনুসন্ধান ও অন্যান্য গনমাধ্যমের সরেজমিন প্রতিবেদনে গেছে, সমবায় অধিদফতর থেকে সমিতি পরিচালনার অনুমোদন নিলেও তারা রীতিমতো  ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব টাকা নিয়ে নিজেদের তৈরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইনভেস্ট দেখিয়ে পরিচালকেরা উচ্চ বেতন নেয়,দামী গাড়ি কিনে কিন্তু প্রতিষ্ঠান থাকে লসে।

পরবর্তীতে এর টাকা তাকে,তার টাকা ওকে দিয়ে জেড়াতালিতে চলছে প্রতিষ্ঠান।  এতে করে সাময়িক লভ্যাংশ পেলেও হাজারো গ্রাহকের আমানত হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত।  সমবায় অধিদফতরের নির্দেশনা মোতাবেক, নারায়ণগঞ্জ এলাকার বাইরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার কোনো অনুমতি না থাকলেও আইন ভঙ্গ করেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেটসহ দেশজুড়ে ৩০০টির অধিক শাখা খুলেছে এসটিসি ব্যাংক।

সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে বিশেষ অনুসন্ধান চালায় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। অনুসন্ধানে এসটিসি ব্যাংকের অনিয়মের এমন চিত্র উঠে এলে অবৈধ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করতে সরকারের কাছে সুপারিশ করে বিএফআইইউ।

এ বিষয়ে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান ক্রাইম ডায়রিকে বলেন, এসটিসি ব্যাংকের ওপর তদন্ত করেছে বিএফআইইউ। তদন্তে দেখা গেছে, আইন অনুযায়ী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাতে পারবে না তারা। তদন্ত প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট অধিদফতরকে দেয়া হয়েছে। 

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া গ্রামের সহজ-সরল জনসাধারণের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে আসছে এসটিসি। ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলাসহ সারাদেশে অবৈধভাবে শাখা অফিস খুলে এ তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। প্রতিষ্ঠানটি লোভনীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকেও হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। এসব কারণে এসটিসি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়েছে।

এছাড়া, এসটিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন নিয়েও রয়েছে জটিলতা। এটি ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই নিবন্ধিত হলেও প্রকৃতপক্ষে সে সময়ের সদস্যদের কোনো অস্তিত্ব নেই। যারা ব্যবস্থাপনা কমিটি বলে এখন দাবি করছে, তারাও দুটি গ্রুপে বিভক্ত। দুটি ব্যবস্থাপনা কমিটির একটি জনৈক আতিকুর রহমানের পক্ষ, যার প্রধান কার্যালয় রাজধানীর মৌচাকের লিলি প্লাজার তৃতীয় তলায়। অপরটি জনৈক আবুল হাসানের পক্ষ, যাদের প্রধান কার্যালয় ফকিরাপুলের এইচ এম সিদ্দিক ম্যানশনে।

জানা যায়, ২০১৯ সালের মে মাসে রাজশাহী নগরের বর্নালী মোড়ে মরিয়ম আলী টাওয়ারের চতুর্থ তলায় প্রতিষ্ঠানটি আঞ্চলিক শাখা অফিস খুলে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার কথা প্রচার করে। ব্যাংকিং কার্যক্রমের মতো সঞ্চয়, ডিপিএস ও চলতি হিসাবসহ সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে এসটিসি। তবে প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘ব্যাংক’ আর অনুমোদন সমবায় অধিদফতর থেকে হওয়ার খবর জানাজানি হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়।

এর বাইরে রাজশাহী নগরের সাগরপাড়ায় এসটিসি ব্যাংকের রাজশাহী শাখা ও বিভাগীয় কার্যালয়, পবা থানার পাশে নওহাটা, বানেশ্বরের ফাতেমা হক প্লাজায় (তৃতীয় তলায়), মোহনপুরের কেশরহাটে, তানোর পৌরশহরের চেয়ারম্যান প্লাজার দ্বিতীয় তলায়, বাগমারার ভবানীগঞ্জ বাজারের গোডাউন মোড়ে শাখা অফিস খুলে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, এসটিসি ব্যাংক সমবায় অধিদফতর থেকে সমবায় সমিতি হিসেবে কেবল নারায়ণগঞ্জ জেলায় কাজ করার অনুমতি নিয়েছে। সংশোধিত উপ-আইন অনুযায়ী কর্ম এলাকার বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা করা সমবায় সমিতি বিধিমালা ২০০৪ এর ১২(২) এর পরিপন্থী। এছাড়া সমবায় আইন ২০০১, সংশোধিত ২০০২ ও ২০১৩ এর ২৩(১) ধারা অনুযায়ী কোনো সমবায় সমিতি তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শাখা অফিস খুলতে পারবে না এবং সমবায় সমিতি আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী সদস্য ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ বা ঋণ প্রদান করতে পারবে না। কিন্তু এ নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করেও সমবায় সমিতির নামের সঙ্গে ‘ব্যাংক’ শব্দটি ব্যবহার করে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে এসটিসি।

এসটিসির ওয়েবসাইট ও প্রসপেক্টাসে দেখা গেছে, প্রথম পাতায় ব্যাংকের ৩০০-র অধিক শাখা থাকার বর্ণনা দেয়া হলেও ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৪৪টির। এসব শখার মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে এসটিসি। মূলতঃ তারা উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহই করে। এসব টাকা নামে বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে সেসব কোম্পানিতে আমানতদারদের শেয়ার কিংবা পরিচালক দেখিয়ে টাকা লগ্নি করে।অথচ প্রতিষ্ঠানের নিয়মের বাইরে গিয়ে প্রতি মাসেই শতকোটি টাকা লস হলেও আমানতদারদের সুদের টাকা পরিশোধ করে।।

তারা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের শেয়ারও বিক্রি করছে বেশ কিছু নাম দিয়ে। এসব শেয়ারের নাম দেয়া হয়েছে—অংশীদার, নিকট, আস্থা, বিশ্বাস, প্রিয়, আমার ও আপন। পাশাপাশি দৈনিক সঞ্চয় প্রকল্প, মুদারাবা মাসিক সঞ্চয়, মুদারাবা শিক্ষা সঞ্চয়, মুদারাবা হজ্জ সঞ্চয় নামে ব্যাংকের মতো আমানতও নিচ্ছে তারা।

এ বিষয়ে এসটিসি ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাংবাদিকদে প্রশ্নের জবাব দিতে আগ্রহই দেখাননি বলে জানিয়েছে একাধিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা। 

জানতে চাইলে সমবায় অধিদফতরের যুগ্ম-নিবন্ধক (ব্যাংক, বীমা ও কৃষি ঋণ) জেবুন নাহার একটি জাতীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, এসটিসি যে নাম ব্যবহার করেছে তা সমবায় ও ব্যাংক কোম্পানি আইনের কোনোটাই সাপোর্ট করে না। তাদের অসঙ্গতি ইতোমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও দুদককে জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করছে। তাছাড়া অনেকগুলো মামলাও চলছে। তাদের নামে। এদিকে একই রকমের আরও শতাধিক প্রতিষ্ঠানের সকল প্রমানক এসে পৌঁছেছে ক্রাইম ডায়রির হাতে। যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহ করছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউ আমানতদারদের শেয়ার হোল্ডার, পরিচালক আবার কোথায়ও বিনিয়োগকারী নামে ফাইলিং করলেও সুদের টাকা তাদের ঠিকই পরিশোধ করছে ব্যাংকের মতো। যা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের বাইরে। দীর্ঘ সময়ের বিনিয়োগকে তারা শেয়ারে রুপান্তর করে বাঁচার চেষ্টাও করছে অনেকে যদিও দুদক হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে পুরনো বোতলে যতই নতুন মদ ঢালা হোক পুরনো জেরের হিসাব তাদেরকে দিতেই হবে বলে জানা গেছে।

  এসংক্রান্ত গোটা বিশেক প্রতিষ্ঠানের পুরো তথ্য প্রমাণ এখন টিম ক্রাইম ডায়রির হাতে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা,বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক,ডিসি অফিসের কর্মচারী, প্রশাসনের অনেক সাবেক ও চলমান কর্মকর্তাসহ অসংখ্য বিনিয়োগকারী আছে যাদের অর্থের উৎস অজ্ঞাত। 

(ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ২য় অংশ)

ক্রাইম ডায়রি // ক্রাইম //সুত্রঃ টিম ক্রাইম ডায়রির  অনুসন্ধান ও অনলাইন মিডিয়ার নিউজ