সমবায় ও বিনিয়োগের নামে ব্যাংকিং কার্যক্রমঃ ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, আটক ৫

তিন শতাধিক মাঠকর্মীর মাধ্যমে পাঁচ-ছয় হাজার মানুষের কাছ থেকে অন্তত দুই শ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা নিজেদের নামে জমি কিনে এবং ব্যাংকে বিনিয়োগ করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। গ্রাহকরা টাকা ফেরত চাইলে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে সবাই আত্মগোপনে চলে যান। বর্তমানে কোম্পানির যে সম্পদ রয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের টাকা অর্ধেকও পরিশোধ করা যাবে না

সমবায় ও বিনিয়োগের নামে  ব্যাংকিং কার্যক্রমঃ ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, আটক ৫

জেলায় তাদের অফিস। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে আরম্ভ করে সরকারি-বেসরকারী কর্মকর্তা এমনকি হ্যাডাম লিডারসহ জনসাধারণের বিশ্বাস অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ও এলাকার বিশ্বস্ত লোককে

শাহাদাত হোসেন রিটনঃ 

কোম্পানি খুলত আর বিনিয়োগ নিত। সিস্টেম ছিল গ্রাহকদের পরিচালক কিংবা শেয়ার হোল্ডার বানানো। আর হ্যা,ইসলামী শরিয়াহ ভিক্তিক বিনিয়োগ ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রকল্পের বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করা হতো গ্রাহকদের। এজন্য ছিল তাদের নিয়োগ প্রাপ্ত একদল দক্ষ পুরুষ ও মহিলা উন্নয়ন কর্মকর্তা। 

র‌্যাব বলছে, তিন শতাধিক মাঠকর্মীর মাধ্যমে পাঁচ-ছয় হাজার মানুষের কাছ থেকে অন্তত দুই শ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা নিজেদের নামে জমি কিনে এবং ব্যাংকে বিনিয়োগ করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। গ্রাহকরা টাকা ফেরত চাইলে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে সবাই আত্মগোপনে চলে যান। বর্তমানে কোম্পানির যে সম্পদ রয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের টাকা অর্ধেকও পরিশোধ করা যাবে না।

 জেলায় তাদের অফিস। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে আরম্ভ করে সরকারি-বেসরকারী কর্মকর্তা এমনকি হ্যাডাম লিডারসহ জনসাধারণের বিশ্বাস অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ও এলাকার বিশ্বস্ত লোককে

এমনকি দু'একজন আড় রাজনীতিক কিংবা প্রশাসনিক লোকজনকে ব্যবহার করে তারা প্রশাসনিক লোকজনকে মুনাফা অর্জনের লোভ দেখিয়ে টাকা নিত।

এমনকি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে স্বল্প সুদে সেই লোনের টাকাই আবার লোন দেয়া হতো। বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে আকৃষ্ট করা হতো গ্রাহককে। এভাবে বিশ্বস্ততা অর্জনের একপর্যায়ে গ্রাহকদের টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয় শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির কর্তাব্যক্তিরা।

প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে সোসাইটির চেয়ারম্যান শাহ আলমসহ পাঁচজনকে নরসিংদী থেকে গ্রেফতার করেছে রথ্যাব। গ্রেফতার অন্যরা হলেন, দেলোয়ার হোসেন শিকদার, কাজী মানে উল্লাহ, সুমন মোল্লাহ ও আবদুল হান্নান মোল্লাহ। জানা গেছে, নরসিংদী থেকে প্রায় পাঁচ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে করোনার অজুহাত দেখিয়ে প্রথমে বন্ধ এবং পরে লাপাত্তা হয়ে যায় শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির কর্মকর্তারা।

RAB বলছে, প্রথম দিকে মুনাফা দিত প্রতিষ্ঠানটি। প্রতি মাসে মুনাফা পাওয়ায় অনেক প্রবাসী তাদের আয়, অনেকে জমি বিক্রির টাকা, এমনকি অন্যান্য ব্যাংকে রাখা টাকাও বিনিয়োগ করেন শাহ সুলতান কো-অপারেটিভে।

জানা গেছে, বিনিয়োগ নেবার জন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতো তারা। একে একে শাহ সুলতান টেক্সটাইল মিল, শাহ সুলতান প্রোপার্টিজ ও সুলতান সুপারশপ, কক্সবাজারে হোটেল, ইমপোর্টেড পন্য আমদানী,ট্রেডিং এবং মার্কেটসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে নিজেদের লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখানোয় বাড়তে থাকে গ্রাহক। পরে পর্যাপ্ত লাভ করতে না পেরে গ্রাহকদের চাপে ব্যবসা গুটিয়ে লাপাত্তা হয় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজারে RAB মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের  বলেন, নরসিংদীর পাঁচ থেকে ছয় হাজার সাধারণ পেশাজীবী অতিরিক্ত লাভের আশায় এ প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তারা তাদের গচ্ছিত টাকা ফিরে পাওয়ার আশায় স্থানীয় সমবায় অধিদফতরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।

ইসলামিক কৌশলে কীভাবে প্রতারণা করছিল এমন প্রশ্নে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতির পরীক্ষা ও ইসলামিক কিছু কৌশল অবলম্বন করে এই প্রতারণা করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণ মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য তারা ধর্মীয় অনুভূতির পরীক্ষা নিতেন। ইসলামি শরিয়া মোতাবেক সবকিছু মেনে চলছেন কি না- এই বিবেচনায় গ্রাহকদের সদস্যপদ ও বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেয়া হতো। এছাড়াও একটি নির্দিষ্ট জেলাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এবং ওই এলাকায় ২০১০ সালের আগে তারা বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা থাকায় মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে।’

গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়া টাকা দিয়ে কী করা হতো- এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, ‘গ্রাহকের টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পার্সেন্টেজ দেয়া হতো; বেতন দেয়া হতো না। আর নিজেদের নামে জমি কিনেছে তারা। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করেছে, আবার সেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। গ্রাহকদের টাকা দিয়ে দুটি টেক্সটাইল মিল ও স্বদেশ প্রপার্টিজ নামে একটি কোম্পানি খুলেছিল।’

জেলা সমবায় অধিদফতর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস নামে ওই প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যালয় বন্ধ করে দেয়। পরিচালনা পর্ষদের সবাই গা ঢাকা দিলে বিষয়টি নিয়ে নরসিংদীতে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ, প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধনসহ চলতে থাকে। এ ঘটনায় নরসিংদীর পলাশ থানা পুলিশ প্রাথমিকভাবে লিখিত অভিযোগ নেয়। বিস্তারিত অনুসন্ধান শেষে অভিযোগটি মামলা আকারে নেয়া হয়।

মামলার পাশাপাশি ভুক্তভোগীরা জেলা প্রশাসন ও সমবায় অধিদফতরে অভিযোগ দেন। তারা আইনি সহযোগিতার জন্য RAB-১১ এর কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। RAB ছায়া তদন্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও RAB-১১ এর অভিযানে শনিবার রাতে নরসিংদী সদর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন সাংবাদিকদের বলেন, ‘শাহ সুলতানের চারটি প্রতিষ্ঠানে পাঁচ থেকে ছয় হাজার গ্রাহক রয়েছে। তাদের তথ্যমতে আরও অনেক টাকার প্রতারণা করেছে। তবে এই টাকাগুলো ব্যাংকে রাখেনি।

‘প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষে ২০ জন থাকলেও পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের তথ্যমতে, করোনাকালীন সময়ে তারা লাভ করতে না পারায় গ্রাহকদের টাকা দিতে পারেনি। 

ক্রাইম ডায়রির নিজস্ব অনুসন্ধান টিমের বরাতে জানা গেছে, বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের যে সম্পদ রয়েছে তা বিক্রি করল ৫০ কোটি টাকার মতো হতে পারে যা দিয়ে ব্যাংক লোন এবং গ্রাহকের টাকার সামান্য একটা অংশ পূরণ হতে পারে তবে  ঋন শোধ হবে না।

ক্রাইম ডায়রি // ক্রাইম