আত্নহত্যা রোধে করণীয়ঃ রাজশাহীতে কৃষি কর্মকর্তার আত্নহত্যা ভাবিয়ে তুলেছে সুশীল সমাজকে

রাজশাহীতে একজন মহিলা কৃষি কর্মকর্তা আত্নহত্যা করেছেন। এর আগে মোশারাত জাহাত,পুলিশ কর্মকর্তা,কিশোর,তরুনী অসংখ্য আত্নহত্যা পুরো দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। একজন সরকারী কর্মকর্তা,তিনি শিক্ষিত,মার্জিত ও রুচিশীল । তিনি কেন আত্নহত্যা করলেন? সমাজটা আজ কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে। সহজেই অনুমান করা যায়।

আত্নহত্যা রোধে করণীয়ঃ রাজশাহীতে কৃষি কর্মকর্তার আত্নহত্যা ভাবিয়ে তুলেছে সুশীল সমাজকে

বাংলাদেশ প্রতিদিন ত্রিশটি মানুষ আত্মহত্যা করে। সুইসাইড শব্দটি একটি ল্যাটিন শব্দ। সুই মানে নিজের, সাইডাম মানে হত্যা। যে পদ্ধতিতে বা যে অবস্থায় মানুষ নিজেকে খুন করে, সেটিই আত্মহত্যা। এই সহজের মধ্যে কঠিন কথা হলো যারা এই প্রতিবেদনটি পড়ছেন এই সময়ের মধ্যেই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কেউ আত্মহত্যা করেছে। কঠিন একটি কথা। পৃথিবীতে আট লাখ মানুষ এক বছরে আত্মহত্যা করে।

 আতিকুল্লাহ আরেফিন রাসেলঃ

বাংলাদেশ প্রতিদিন ত্রিশটি মানুষ আত্মহত্যা করে। সুইসাইড শব্দটি একটি ল্যাটিন শব্দ। সুই মানে নিজের, সাইডাম মানে হত্যা। যে পদ্ধতিতে বা যে অবস্থায় মানুষ নিজেকে খুন করে, সেটিই আত্মহত্যা। এই সহজের মধ্যে কঠিন কথা হলো যারা এই প্রতিবেদনটি পড়ছেন এই সময়ের মধ্যেই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কেউ আত্মহত্যা করেছে। কঠিন একটি কথা। পৃথিবীতে আট লাখ মানুষ এক বছরে আত্মহত্যা করে।

সম্প্রতি রাজশাহীতে একজন মহিলা কৃষি কর্মকর্তা আত্নহত্যা করেছেন। বিষয়টি পুরো দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। একজন সরকারী কর্মকর্তা,তিনি শিক্ষিত,মার্জিত ও রুচিশীল । তিনি কেন আত্নহত্যা করলেন? সমাজটা আজ কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে। সহজেই অনুমান করা যায়। পুঠিয়ার ডাঙাপাড়ায় খাদিজা খাতুন (৩৫) ।  তিন সন্তানের জননী তিনি। আত্মহত্যা করেছেন। তিনি রাজশাহীর পবা উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও রাজশাহী পুলিশ লাইন স্কুল ও কলেজের শিক্ষক আবদুল ওহাবের স্ত্রী।

খাদিজার স্বামী জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাতে খাওয়া শেষে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। রাতে ঘুম ভাঙলে দেখি তিনি পাশে নেই। পরে খুঁজে দেখি বাড়ির গেটের আড়ার সাথে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে তিনি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছেন। বুধবার ভোরে তারা তাকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে ওড়না কেটে লাশ নামিয়ে মেঝেতে রেখে থানায় খবর দেয়। পরে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে।

আত্নহত্যা কোন কাংখিত সমাধান নয়। এর কারন খুজে বের করতে হবে। মানুষের মানসিকাতর পরিবর্তন হচ্ছে। অন্তরালের বিষয়গুলি বের করে আনতে হবে। বাংলাদেশের কথা যদি বলি, প্রতিদিন ৩০টি মানুষ আত্মহত্যা করে। ২০১৭ সালে এক বছরে বাংলাদেশে ১১০০ মানুষ আত্মহত্যা করেছে। এটা শুধু প্রতিবেদন। পুলিশের খাতায় এসেছে। এর বাইরেও কিন্তু অনেক থাকতে পারে। কঠিন আরেকটি কথা, ২৫ গুণ বেশি মানুষ কিন্তু আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। একজন আত্মহত্যা করে। কিন্তু ২৫ জন মানুষ কিন্তু চেষ্টা করে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই, একটি মানুষ আত্মহত্যা করল,  প্রায় ১৫০ জন মানুষ কিন্তু ভোগে। সেটা পরিবার হোক, বন্ধু হোক, আত্মীয়-স্বজন হোক, অন্য সংস্থা হোক, টিভি হোক, পত্রিকা হোক, তারাও এর মধ্যে জড়িত। আপনি যদি হিসাব করেন, প্রতি বছর ১০০ কোটি মানুষ ভুগছে কোনো না কোনো বিষয়ে। এই আত্মহত্যার কারণের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।

Things to do to prevent suicide:In Rajshahi, the suicide of an agricultural officer has made the civil society think

আত্নহত্যার জন্য বিখ্যাত পশ্চিমা বিশ্বে কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতা কমছে। কিন্তু আমরা যারা উন্নতির দিকে যাচ্ছি, জীবন জটিল হয়ে যাচ্ছে। জটিল জীবন। মানুষের মধ্যে জটিলতা বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিক কারণ, সামাজিক কারণ। সব মিলিয়ে আমাদের অঞ্চলে কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। 

বংশ পরম্পরা কিন্তু একটি বিষয় রয়েছে। মানসিক কারনেও অভিমানি ব্যক্তিরা আত্নহত্যা করতে পারে।   আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কারণ থাকল, কিন্তু কিছু উদ্দীপ্তকারী ফ্যাক্টর থাকল। সে হয়তো অস্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এই আত্মহত্যার বিষয়টি তার জিনের মধ্যে রয়েছে। যেমন : একজনের হয়তো ভালোবাসা ভেঙ্গে গেল, একজনের চাকরি নেই, চাকরি চলে গেল। একজন কোনোভাবে বঞ্চিত হলো, একজন মেয়ে ধর্ষিত হলো, একজন ইভ টিজিংয়ের শিকার হলো, পরীক্ষায় ফেল করল, তার জন্য একটি আইনের লড়াই করতে হলো, সামাজিকভাবে হেয় হলো, অপদস্ত হলো-এগুলো হলো উদ্দীপ্তকারী কারণ। তাদের মধ্যে চাপ বহন করার ক্ষমতা কম থাকে। তারা সমাজের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারে না। আরেকটি কারণ আমি বলতে চাই, সেটি হলো সামাজিক কারণ।

একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, যিনি মনে করছেন, আমার সমাজে কোনো জায়গা নেই, সমাজে আমার কোনো প্রয়োজন নেই, আমি সমাজের কাছে একজন উচ্ছিষ্ট ব্যক্তি, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না, আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, সে কিন্তু আত্মহত্যা করতে পারে। এগুলোতে মোটামুটি আত্মহত্যার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারি।

বংশ পরম্পরায় এটি খুব বেশি হয়। আমাদের দেশের ঝিনাইদহতে আত্নহত্যা খুব বেশি হয়। অঞ্চলটা একটি কারণ কিন্তু। আত্মহত্যার ৭০ ভাগ কারণ হলো মনোরোগ। যে আত্মহত্যা করেছে সে হয়তো মনোরোগে ভুগছে। বিষণ্ণতা আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। এখানে মানুষ আশাহত থাকে। অসহায়বোধ করে। জীবনের প্রতি তার কোনো মায়া থাকে না। তার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। এসব কারণে কিন্তু বিষণ্ণতায় আত্মহত্যার হার বেশি। ৭০ ভাগ মানসিক রোগের কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে আবার ৭০ ভাগ কারণ হলো বিষণ্ণতা। সুতরাং বিষণ্ণতা কিন্তু আত্মহত্যার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। এ ছাড়া সিজোফ্রেনিয়া নামে একটি কঠিন মানসিক রোগ রয়েছে। আরো কিন্তু ১০ ভাগ আত্মহত্যা করতে পারে। ইমপালস কনট্রোল ডিজঅর্ডার, সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হঠাৎ এ ধরনের আচরণ করে ফেলে। আবেগীয়ভাবে সে এত বেশি অপরিপক্ব যে কিছু হলেই সে হঠাৎ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। অনেক সময় সফল হয়ে যায়। যারা মাদক সেবন করে তারাও কিন্তু আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে। অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার বলে আরেকটি রোগ রয়েছে, এখানেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। সুতরাং এ সব মানসিক রোগ কিন্তু আত্মহত্যার জন্য গুরুতর কারণ।

 আত্মহত্যার প্রতিরোধ কিন্তু খুব সহজ। আত্মহত্যা কিন্তু প্রতিরোধ করা সম্ভব। তো যদি আমি প্রতিরোধ করতে চাই, তাহলে কিন্তু কাজ অনেক। কী কাজ করতে হবে? কাজ করতে হবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং পরিবার থেকে। আত্মহত্যার প্রতিরোধ করতে হলে প্রথমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ করতে হবে। অভিভাবক ও পরিবার এখানে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যদের বুঝতে হবে বিষয়টি। তাদের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। আমার সমাজও কিন্তু এখানে অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এমনকি মওলানা সাহেব খুব ভালো ভূমিকা পালন করতে পারেন। স্কুলের মাস্টার সাহেব, মাতবর সাহেব কিন্তু ভালো ভূমিকা পালন করতে পারেন। এখানে কিন্তু ধর্মীয় বিষয়টিও রয়েছে। প্রায় সব ধর্মেই কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ। এমন কোনো ধর্ম নেই যেখানে আত্মহত্যা মেনে নেওয়া হয়। সুতরাং এটিও কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হেলথ কেয়ার সার্ভিসটা কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কারণ হলো মানসিক রোগ। মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যদি উন্নত থাকে, যদি জানে এটি একটি মানসিক সমস্যা, তাহলে এটি প্রতিরোধ সম্ভব। এরপর ইলেকট্রনিক ও  প্রিন্ট মিডিয়া। তারা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আত্মহত্যা করলে একটি পরিবার শেষ হয়ে যায়, আত্মহত্যা দেশের জন্য, মানুষের জন্য কত ক্ষতি, এই প্রভাবটা যদি আমরা তৈরি করতে পারি, বোঝাতে পারি তাহলে ভালো।

আমরা যদি শরীরচর্চা করি, ব্যায়াম করি, একটু দৌড়াদৌড়ি করি,  জগিং করি, তাহলে মস্তিষ্ক একটি রাসায়নিক তৈরি করে। এই রাসায়নিকটার  নাম অ্যান্ডোরফিন। অ্যান্ডো মানে ভেতরে। আর মরফিন বের হলে আনন্দ তৈরি হয়। সুখানুভূতি তৈরি হয়। অ্যান্ডোরফিন যদি মস্তিষ্কে তৈরি হয়, তাহলে আমাদের মধ্যে কিন্তু সুখানুভূতি তৈরি হবে। দশটা রোগ কম হবে, আপনি যদি ব্যায়াম করেন। উচ্চ রক্তচাপ কম হবে, ডায়াবেটিস হবে, আরথ্রাইটিস হবে না, হার্টের রোগ কম হবে। পাশাপাশি মনের ভালো লাগাটাও বাড়বে।

আমি বলছিলাম, বিষণ্ণতা আত্মহত্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ওষুধ, চিকিৎসক এগুলো বাদ দিলাম। একটি স্লোগান ছিল টক এবাউট ডিপ্রেশন। চলুন, বিষণ্ণতা নিয়ে আমরা কথা বলি। মনেরভাব প্রকাশ করি। আমি যেহেতু অসহায়, একটি আশার পথ দেখি। কোনো পথ পাওয়া যায় কি না। কারো সঙ্গে কথা বলেও তো পথটা পাওয়া যেতে পারে। কারো সঙ্গে কথা বললে হয়তো আপনি সহমর্মিতা পাবেন। কাছের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে পারি। কিংবা সাইকোলজিস্ট, কাউন্সেলর সবার কাছে যাওয়া যেতে পারে।

যখন একজন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল বা তার আইডিয়া রয়েছে বা আত্মহত্যার একটি প্রবণতা রয়েছে, তাকে কিন্তু চিহ্নিত করা সম্ভব। পরিবারের মানুষ কিন্তু চিহ্নিত করতে পারে যে আত্মহত্যার কথা সে বলছে। সে বলে দিচ্ছে, আর আমার সঙ্গে দেখা হবে না। বিদায় বলে দিচ্ছে। অনেক সময় সুইসাইডাল নোট লিখে ফেলে। অনেক সময় উইল করে ফেলে। অনেক সময় বিষণ্ণতার কারণে ঘরকুণো হয়ে পড়ে। এ সময় যে আপনি কথা বলবেন, কিছু কথার মধ্যে সেই সব জিনিস বুঝতে হবে। কথাগুলো যেন হয় প্রাণ থেকে। সে যেন বুঝতে পারে আপনি তাকে সত্যিকারভাবেই সাহায্য করতে চাচ্ছেন। এটা যেন এ রকম না হয় যে আপনি লোক দেখানো বা ভাসা ভাসা কথা বলছেন। সে লোকটি যে বোঝে তার প্রতি আপনি সহমর্মী। সে যেন বোঝে তার সমস্যাটা আপনি সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। এখানেই যেন সে আশ্রয় পায়। তার সঙ্গে তর্ক করা যাবে না কিন্তু। যুক্তি তখন দেওয়া যাবে না। যুক্তি দিবেন। কিন্তু আগে তাকে মানসিকভাবে স্থিতিপূর্ণ অবস্থায় নিতে হবে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে আত্নহত্যা প্রবণতা সহজেই শুন্যের কোঠায় আনা সম্ভব।

ক্রাইম ডায়রি// স্পেশাল