কিশোর অপরাধ;কারণ, আমাদের করণীয় ও পুলিশের ভূমিকা

Juvenile delinquency; because, our duties and the role of the police

কিশোর অপরাধ;কারণ, আমাদের করণীয় ও পুলিশের ভূমিকা

আতিকুল্লাহ আরেফিন রাসেলঃ-----

কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে সঙ্গ দলের প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিশোর-কিশোরীরা এই বয়সে পরিবারের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে চায় এবং পাড়া-প্রতিবেশী, খেলার সাথী সমবয়সীদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এ ধরনের সম্পর্কের মাধ্যমে শিশু-কিশোররা অত্যন্ত সহজে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে, যা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন বা পরিবার-পরিজনের নিকট থেকে তা করতে পারে না। সামাজিক পরিবেশ পরিবারের ভূমিকার পরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রভাব শিশু-কিশোরদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজেও সকল প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যেমন শিক্ষকের বিষয়জ্ঞান, সততা, আন্তরিকতা, ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক, ছাত্রছাত্রীর নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চেতনা কার্যত অনুপস্থিত। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য গঠনমূলক চিত্তবিনোদন, খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা ও শিক্ষকদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবও প্রকট।


কিশোর অপরাধ প্রত্যয়টির সংজ্ঞায়নে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। সমাজতাত্তি¡ক দৃষ্টিকোণ থেকে কিশোর বয়সে অবাঞ্ছিত ও সমাজ বিরোধী আচরণ সম্পাদন করাকেই বলা হয় কিশোর অপরাধ। মার্কিন অপরাধ বিজ্ঞানী ঈধাধহ বলেন, সমাজ কর্তৃক অনাঙ্খত আচরণ প্রদর্শনে কিশোরদের ব্যর্থতাই কিশোর অপরাধ। আইনগত দিক থেকে কিশোর অপরাধ বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে কর্তৃক আইন বিরুদ্ধ দন্ডনীয় কর্ম সম্পাদন করাকেই বুঝায়। এ প্রসঙ্গে ১৯৮০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত দ্বিতীয় কংগ্রেস অধিবেশনের কিশোর অপরাধের নির্ধারিত সংজ্ঞাটি উল্লেখ করা যেতে পারে। কিশোর অপরাধ বলতে কমিশন সে কাজকে বুঝায়, যে কাজ একজন বয়স্ক ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হলে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে কিশোর অপরাধের পরিচয়ে বলা যায় যে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে কর্তৃক সংঘটিত দেশীয় আইন, সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী কর্মকা-কেই কিশোর অপরাধ বলে। কৈশোরকাল মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ স্তর শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রত্যেক মানব সন্তানের ওপর বিভিন্ন শর’ঈ বিধি-বিধান ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব আরোপিত হয়। এর আগ পর্যন্ত সকিশোর-কিশোরীরা বিধি-বিধান পালনের বাধ্যবাধকতামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। কেননা হাদিসে তিন ব্যক্তিকে শরী’আতের বিধান পালনের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তিন ব্যক্তি যাবতীয় দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছে; ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগ্রত হয়, অপ্রাপ্ত বয়স্ক যতক্ষণ না বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং পাগল যতক্ষণ না সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন হয়। শাস্তি প্রদান করার নিদের্শনা ইসলামী আইনে বিদ্যমান রয়েছে।’ যেমন রাসূলুল­াহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানের বয়স সাত বছরে পদার্পণ করলে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিবে। দশ বছর বয়সের পর সালাত আদায় না করলে তাদেরকে প্রহার করবে এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দিবে।’
এ প্রসঙ্গে ড. আব্দুল আযীয আমির এর অভিমতটি উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর মতে, একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু-কিশোর ব্যভিচার চুরি অথবা ডাকাতির মতো অপরাধ করলে সামাজিকভাবে তাকে অপরাধী বলে গণ্যই করা হবে না-এমনটি মনে করা ঠিক নয়। কেননা তা হবে আইনের অপব্যাখ্যা মাত্র। বরং উত্তম হলো যে, প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির অপরাধের ন্যায় শিশু-কিশোরদের ওপর সুনির্দিষ্ট শাস্তিযাগ্য গুরুতর অপরাধ করে অথবা সুনির্দিষ্ট তা’যীরী অপরাধসমূহের মধ্যে কোন একটি অপরাধ সংঘটন করে তাহলে তার অপরাধের মাত্রা বয়সের উপযুক্ততা বিচার করে সংশোধনমূলক কোন শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে ইসলামী আইনে কোন বাধা-নিষেধ নেই। অতএব, ইসলামের দৃষ্টিতে কিশোর অপরাধ বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে কর্তৃক শরী’আতের এমন আদেশ নিষেধের লঙ্ঘনকে বুঝায়, যা করলে তা’যীর প্রযোজ্য হয়।
কিশোর অপরাধের সুনির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন বিষয়। তথাপিও অপরাধবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিশোর অপরাধের কারণ অনুসন্ধানের প্রয়াস চালিয়েছেন। যা অপরাধের নানাবিধ সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে ধারণা লাভে সহায়ক। কিশোর অপরাধের কারণ উলে­খ করতে গিয়ে প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবী অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, বর্তমানের ধর্মহীনতাই অন্যান্য অপরাধের ন্যায় কিশোর অপরাধের কারণ। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের জনক কার্লমার্কস এর মতে, কিশোর অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক প্রভাব। আধুনিক অপরাধবিজ্ঞানের জনক সিজার লোমব্রোসো কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে জৈবিক প্রভাবকে দায়ী করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী হিলি এবং ব্রোনোর কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে সামাজিক পরিবেশের প্রভাবকে চিহ্নিত করেছেন। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড কিশোর অপরাধের কারণ অনুসন্ধানে বাহ্যিক পরিবেশের পরিবর্তে মানুষের মনোজগতের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। বংশগতি বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জৈবিক বৈশিষ্ট্য কিশোর অপরাধের অন্যতম একটি কারণ। শিশু উত্তরাধিকার সূত্রে যে দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য লাভ করে সেটিই তার বংশগতি জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, ব্যক্তির মন-মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-ব্যবহার, চিন্তাধারা, প্রভৃতি বিষয়। বংশগতির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে।


জন্মগতভাবে শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে তারা স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্র¯স্ত করে। ফলে তারা স্বাভাবিক আচরণ। অপরাধমূলক কর্মে জড়িয়ে পড়ে। জন্মগত শারীরিক ও মানসিক ত্রুটিগুলো যেমন মাথার খুলি স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট বা বড়, গাঢ় ও ঘন ভ্রু, চেপ্টা নাক, প্রশ¯স্তহাতের তালু, প্রশস্ত কান, ঘন চুল, লম্বা বাহু, চোখ বসা, হাত-পায়ে অতিরিক্ত আঙ্গুল, সংকীর্ণ কপাল, অসামঞ্জস্য দাঁত, আত্ম-নিয়ন্ত্রণহীন, অলস প্রকৃতি ও বেদনার প্রতি অতি সংবেদনশীল ইত্যাদি। উপর্যুক্ত ত্রুটিগুলো থেকে পাঁচটি ত্রুটি শিশু-কিশোরের মধ্যে বিদ্যমান থাকলে অপরাধকর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ড. হিলি শিকাগো শহরে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কিশোর অপরাধীদের ৩১% এর দৈহিক বিকাশ অস্বাভাবিক। এছাড়াও ইতালিতে সা¤প্রতিক গাবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, দৈহিক অক্ষমতা দূর করা গেলে কিশোরদের অপরাধমূলক আচরণ থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।
কিশোর অপরাধ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সব সময় পরিবারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি। পরিবারের সূচনা হয় স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে আর পারিবারিক পরিমন্ডলে সন্তানের জন্ম হয় এবং বিকাশ লাভ করে। সন্তানের স্বাভাবিক ও সুস্থ বিকাশের জন্য পিতামাতার মধ্যে স¤প্রীতিময় দাম্পত্য জীবন একান্ত অপরিহার্য। পিতা-মাতার মধ্যে মনোমালিন্য ও কলহ বিবাদ থাকলে সন্তানের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে, যা পরিণামে শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।


অর্থনৈতিক অবস্থা উলে­খযোগ্যভাবে কিশোর অপরাধের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। দরিদ্র ও সম্পদের প্রাচুর্য উভয়ই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভবে কিশোর অপরাধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দরিদ্রতার কারণে মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে কিশোররা বিভিন্ন প্রকারের অপরাধে লিপ্ত হয়ে থাকে। কিশোর অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে পারিপাশির্^ক সামাজিক পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম। বিধায় আবাসিক পরিবেশ, সঙ্গীদের প্রভাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, সামাজিক শোষণ-বঞ্চনা ইত্যাদি সামাজিক উপাদানগুলো শিশু-কিশোরদের আচরণে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। শিশু-কিশোরদের নৈতিক ও সামাজিক আচরণের ওপর আবাসিক পরিবেশের প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এজন্যই বাসস্থানের অনুপযুক্ত পরিবেশ (যেমন : ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকা) কিশোর-কিশোরীদের অপরাধমূলক কর্মকা-ে ধাবিত করতে পারে। বিভিন্ন আবাসিক এলাকার ওপর পরিচালিত গবেষণামূলক জরিপে প্রতীয়মান হয় যে, বস্তি এলাকার লোকজন সাধারণত অস্থায়ী বাসিন্দা হয় এবং তারা ঘন ঘন বাসস্থান পরিবর্তন করে। তাদের পরস্পরর মধ্যে সামাজিক সংযোগ ও সংহতি থাকে না। এরূপ পরিবেশে শিশুরা ঘরের বাইরে অবাধে অপরাধমূলক আচরণে লিপ্ত হয়।
কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে সঙ্গদলের প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিশোর-কিশোরীরা এই বয়সে পরিবারের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে চায় এবং পাড়া-প্রতিবেশী, খেলার সাথী সমবয়সীদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এ ধরনের সম্পর্কের মাধ্যমে শিশু-কিশোররা অত্যন্ত সহজে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে, যা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন বা পরিবার-পরিজনের নিকট থেকে তা করতে পারে না। সামাজিক পরিবেশ পরিবারের ভূমিকার পরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রভাব শিশু-কিশোরদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজেও সকল প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যেমন শিক্ষকের বিষয়জ্ঞান, সততা, আন্তরিকতা, ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক, ছাত্রছাত্রীর নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চেতনা কার্যত অনুপস্থিত। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য গঠনমূলক চিত্তবিনোদন, খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা ও শিক্ষকদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবও প্রকট।
বর্তমানে জটিল আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পেশা গ্রহণে ব্যর্থ কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারার কারণে সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়। ফলে তাদের মনে তীব্র হতাশা ও নৈরাশ্য দানা বাঁধে, যা এক পর্যায়ে সমাজের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও আক্রোশ রূপ নেয়। এমন পরিস্থিতিতে এই ব্যর্থ কিশোর-কিশোরীরা সামাজিক আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে এবং অপরাধমূলক আচার-আচরণে লিপ্ত হয়। অপরাধ বিজ্ঞানী ডেক্সটারের মতানুযায়ী, বায়ুর চাপের সাথে মানুষের ¯œায়ুবিক চাপ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত এবং তার ফলে ব্যারোমিটারে পারদের ওঠা-নামার সাথে অপাধ প্রবণতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে।
পিতা-মাতার ঘন ঘন কর্মস্থল পরিবর্তনের কারণে শিশু-কিশোররা নতুন নতুন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সংস্পর্শে এসে সহজেই তা অনুসরণ করতে পারে না এবং তাদের ব্যক্তিত্ব অসম্পূর্ণভাবে বেড়ে উঠে। ফলে এটি শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার জন্ম দেয়। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, ইউটিউবের ন্যায় গণমাধ্যমগুলো শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই উক্ত গণমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেগে ভরপুর ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিশোর-কিশোরীদের মন-মানসিকতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
কিশোর অপরাধ প্রতিকারে ইসলামের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যম-িত। সঠিক পন্থার শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ না হওয়ার কারণেই মূলত কিশোর অপরাধ সংঘটিত হয়। এছাড়াও যেসব কারণে এই ব্যাধির সৃষ্টি হয়, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কিশোর অপরাধ প্রতিকার করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ইসলাম সর্বজন স্বীকৃত প্রতিরোধমূলক ও সংশোধনমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমে তা প্রতিকার করেছে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় ইসলাম বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষা প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। আর সংশোধনমূলক ব্যবস্থায় নিয়েছে বাস্তবসম্মত নানা পদক্ষেপ।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলতে বুঝায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে যাতে প্রথম থেকেই অপরাধ প্রবণতার সৃষ্টি না হয়, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করা। যেসব কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা দেখা যায়, সেগুলোকে আগে থেকে দূর করাই এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উত্তম স্থান হলো পরিবার। জন্মের পর শিশু পারিবারিক পরিবেশ মাতা-পিতার সংস্পর্শে আসে। শিশুর সামাজিক জীবনের ভিত্তি পরিবারেই রচিত হয়। তাই তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এ জন্যই ইসলাম শৈশবকাল থেকে ঈমানের শিক্ষা, ইবাদতের অনুশীলন, ইসলামের যথার্থ জ্ঞানার্জন ও নৈতিকতা উন্নয়নের দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে পরিবারের উপরে। যাতে করে আগামীদিনের ভবিষ্যৎ শিশু-কিশোররা অপরাধমুক্ত থাকতে পারে। আল­াহতায়ালা মুমিনদেরকে এবং তাদের পরিজনদের অপরাধমুক্ত জীবনযাপন করার মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের নির্দেশ দিয়ে বলেন, “হে বিশ^াসীগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।” অতএব বলা যায় যে, কিশোর-কিশোরীর আচরণ ও ব্যক্তিত্বের উন্নয়নে পরিবার সর্বাধিক অনুকূল পরিবেশ জোগায়। বিশেষ করে এক্ষেত্রে পিতা-মাতার ভূমিকা অপরিসীম। কেননা তারাই শিশু-কিশোরের সামনে বহির্বিশে^ বাতায়ন প্রথম উন্মুক্ত করে দেয় এবং সন্তানদের অনুপম চরিত্র গঠনের কার্যকর অবদান রাখতে পারেন। এভাবে অভিভাবকগণ পর্যায়ক্রমে সন্তানদের সামনে ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো যেমন আল­াহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং আখিরাতের প্রতিটি পর্যায় যেমন কবর, হাশর, জান্নাত, জাহান্নাম এবং ভাগ্যের ভালো-মন্দের পরিচয় অত্যন্ত সুন্দর ও যৌক্তিকভাবে তুলে ধরে সেগুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ^াস স্থাপনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবেন। ফলে সন্তানের ঈমান হবে সুদৃঢ়। তার ঈমান দৃঢ় ও শিরকমুক্ত হলে নৈতিক গুণাবলী অর্জন তার জন্য অত্যন্ত সহজ হবে। মাতা-পিতা সন্তানকে ঈমানের শিক্ষা প্রধা পর ইসলামের যথার্থ জ্ঞান দান করবে এবং তাদের অনুসন্ধিৎসাকে জাগিয়ে তুলবেন। যাতে করে তারা অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা ভালো-মন্দের, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নিরপণ করতে পারে এবং নিজেদেরকে বিরত রাখতে পারে অপরাধকর্ম থেকে। বিশ^বরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (রহ.) চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘চরিত্র হলো মানব মনে প্রোথিত এমন অবস্থা, যা থেকে কোন কর্মচিন্তা-ভাবনা ছাড়াই অনায়াসে প্রকাশিত হয়।’ আর মানুষের আচার-আচরণ ও কাজ-কর্ম সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা আদর্শের শৈশবকাল থেকেই মূলত নৈতিকতা বিকশিত হওয়া শুরু হয় এবং কৈশোরকালের শেষ পর্যায়ে গিয়ে চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। শিশু-কিশোরের নৈতিকতা উন্নয়নে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য। মা-বাবা নৈতিকতা মেনে চলতে শিখবে।
পিতা-মাতা সন্তানদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজ সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন করার শিক্ষা দেবেন যেমন : খাবার, পানাহার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পারস্পরিক সাক্ষাৎ ও গ্রহে প্রবেশের শিষ্টাচারসহ যাবতীয় আদব। যা তাদের নৈতিক মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। শিশু-কিশোররা যে সমাজে বসবাস করে সে সমাজেরও রয়েছে অসংখ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। সমাজে যদি অন্যায়-অনাচার অবাধে চলতে থাকে, তাহলে শিশু-কিশোররা তা অনুসরণ করে অপরাধ প্রবণ হতে পারে। ফলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সমাজ থেকে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ প্রতিরোধ করতে হলে কেবলমাত্র শিশু সমাজকে উন্নত করলেই চলবে না, বরং সমগ্র সমাজের উন্নয়ন করতে হবে। সমাজের নৈতিক আদর্শ, পারস্পরিক আচরণ, কর্তব্যপরায়ণতা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।


বাংলাদেশে সংশোধনমূলক কার্যক্রম
বর্তমানে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান আছে। বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৪৯ সালে ঢাকায় ইৎড়ংঃধষ ঝপযড়ড়ষ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে কিশোর আদালত এবং টঙ্গীতে কিশোর সংশোধনী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। এ ছাড়া কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের জন্য কিশোর হাজত, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রবেশন, প্যারোলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের ওপর গুরুত্বারোপ করে অপরাধী কিশোরদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা। আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে কিশোরদের সংশোধনের ব্যবস্থা করাই এ সকল কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য।
কিশোর অপরাধ মোকাবিলার উপায়
কিশোর অপরাধের ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করে আমাদের সকলের উচিত কিশোরদের অন্ধকার থেকে আলোর জগতে ফিরিয়ে আনা। কিশোর অপরাধ সৃষ্টিতে শুধু কিশোররাই দায়ী নয়। এজন্য দায়ী আমাদের পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থা, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা। তাই সরকারি প্রচেষ্টা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কিশোর অপরাধ মোকাবিলায় নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে-
- কিশোর অপরাধ মোকাবিলায় সর্বপ্রথম এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

- কিশোরদের সুষ্ঠু আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে যতœবান হতে হবে।

- সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র শিশু কিশোরদের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

- শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে পিতামাতাকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সন্তানের ভালোলাগার ও মন্দলাগাকে বিচার করতে হবে।

- কিশোরের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের জন্য গঠনমূলক পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

- দেশে পর্যাপ্ত কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।

- স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমগুলো শিশুর মানসিক বিকাশের উপযোগী কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারে।

মূলকথা
কৈশোরকাল মানুষের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের সময়। এ সময় থেকেই মানুষ অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে পরিপূর্ণ জীবন গড়ে তুলতে শুরু করে। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের কারণে অকালেই সে আশাহত হয়। হতাশা আর নৈরাজ্য জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। কিশোরের সুপ্ত প্রতিভা অঙ্গুরে বিনষ্ট হওয়ায় তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাই যে সকল বহুমুখী কারণে কিশোর অপরাধের সৃষ্টি তা রোধ করতে হবে। আমাদের বর্তমান কিশোরদের প্রকৃত মানুষ ও নিরপরাধী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই জাতির উন্নতি সম্ভব।
পুলিশ রাষ্ট্রের অপরিহার্য একটি অঙ্গ। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান তাদের দায়িত্বে। তাই প্রত্যাশা সংগত যে তারা দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনকে মূলনীতি হিসেবে অনুসরণ করবে। দেখার থাকে আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানটি তাদের দায়িত্ব পালনে কতটা কার্যকর ভূমিকায় আছে। শুরুতেই বলতে হবে ১৬ কোটি লোকের ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশটির শাসনকাজ দুরূহ। এখানে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু অপরাধ ঘটতেই পারে। আর তা ঘটছেও। অনেকে বলে থাকেন, কোনো কোনো উন্নত দেশে সংগঠিত অপরাধের চেয়ে আমাদের এখানে অপরাধের হার কম। তবে পার্থক্য হলো সেসব দেশে অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হয়। তদন্ত হয় যথার্থ। বিচার হয়। এর অন্যথা হওয়ার সুযোগ খুব কম। আর আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া অপরাধে তদন্ত প্রক্রিয়া শ্লথ। ক্ষেত্রবিশেষে ত্রুটিপূর্ণ। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও রয়েছে। তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ পায় অভিযুক্ত ব্যক্তি। আদালতের সাক্ষ্য–প্রমাণ হাজির করা খুব কঠিন কাজ। আর অপরাধ যথার্থভাবে প্রমাণ করতে না পারায় আসামি পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে উৎসাহিত হয় অন্য অপরাধীরা।
সা¤প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া কিছু অপরাধ আমাদের বিচলিত করছে। তার মাঝে আছে বিদেশি, ভিন্ন ধর্ম বা মতাবলম্বী ব্যক্তিদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা। আছে নিষ্পাপ শিশু-কিশোরকে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে নৃশংস হত্যার ঘটনাও। সাগর-রুনি নামের এক সাংবাদিক দম্পতি নিহত হওয়ার ঘটনাটিও অনুদ্ঘাটিতই থাকল। এটা খুবই অস্বাভাবিক। হবিগঞ্জের বাহুবলে চার শিশু হত্যার তদন্ত স্বাভাবিক গতিতেই চলছিল। এর মাঝে প্রধান আসামির ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনাটি আইনের শাসনের ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। সিলেটে রাজন হত্যার আসামিদের বিচারের আওতায় আনতে মূল ভূমিকায় ছিলেন স্থানীয় জনগণ। তাঁদের ন্যায্য আবেগের ফলে তদন্ত ও বিচার দ্রুত সম্পন্ন হয়। দুঃখজনকভাবে এ ঘটনায় পুলিশের কিছু সদস্য অপরাধীদের পক্ষ নিয়েছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। ঢাকার মতিঝিলে ঘরোয়া হোটেলের মালিক গুলি করে তাঁর হতদরিদ্র কিশোর কর্মচারীকে মেরে ফেলেন। আসামি গ্রেপ্তার বা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায় না। কেউ যদি মামলাটির অপমৃত্যুর আশঙ্কা করেন, তাহলে তা অমূলক বলা যাবে না। দেশের উত্তরাঞ্চলে একজন হিন্দু ধর্মগুরু নিহত হয়েছেন। সেখানে একটি মঠ ধ্বংসের খবরও আমাদের ব্যথিত করেছে। এগুলোর দ্রুত তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় না আনলে পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকে। কয়েকজন বিদেশিকে হত্যার বিষয়টি অভাবনীয়। আর তা-ও নিতান্ত নিরীহ ব্যক্তিদের। ভিন্নমতাবলম্বী ব্লগাররা কারও অনুভূতিতে আঘাত দিলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। কিন্তু তা না করে তাঁদের পরিকল্পিতভাবে হত্যার জন্য সচেষ্ট একটি গোষ্ঠী। তারা সচেষ্ট দেশের সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বিনষ্ট করতেও। ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা শিয়া, আহমদিয়া স¤প্রদায়ের বিরুদ্ধেও তারাই সক্রিয়। এমনকি এ ধরনের হামলায় নিহত হয়েছেন দুজন পীর। তাঁদের মত কেউ সমর্থন না করলেও হত্যা করা যায় না। এগুলোকে আমরা যথাসময়ে দৃশ্যমানভাবে আইনের আওতায় আনতে পারিনি। তা দ্রুত করা গেলে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লাল সংকেত পাবে।
জনগণের বড় সংশয় পুলিশের কিছু সদস্য ক্রমবর্ধমান হারে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সংবাদে। প্রায় সব সংস্থাতেই অসৎ লোক আছে। তবে পুলিশ একটি অস্ত্রধারী সুশৃঙ্খল বাহিনী। জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হলে মোকাবিলায় পুলিশই অগ্রভাগে। কারও জানমাল বিপন্ন হলে ছুটে যেতে হয় তাদের কাছে। সে পুলিশকে সবাই বন্ধু আর সজ্জন হিসেবে চায়। তাদের অনেকেই তা আছে। কিন্তু সবাই নয়। এসব ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রে উত্তরণের পর জনপ্রশাসনে দলীয়করণের মৃদু হাওয়া আসতে থাকে। তবে পালে জোর বাতাস পায় ২০০১ সালের পর থেকে। আর তীব্রতা বেড়েই চলছে। ফলে সব সরকারি চাকরিতেই সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমতাসীন দলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের কারও না কারও আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তি। প্রবণতাটি প্রধানত ভর করেছে প্রশাসন ও পুলিশে। তারা বেপরোয়া। চেইন অব কমান্ড অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল।
অপরাধ জগৎকে উসকে দেওয়ার পেছনে আরেকটি বিষয় ব্যাপক প্রভাব রাখছে বলে অনেকেই মনে করেন। তা হলো ‘রাজনৈতিক কারণে’ মামলা প্রত্যাহার আর রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে দণ্ডিত এমনকি প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত আসামিকে মুক্তি দেওয়া। ২০০১ আর ২০০৯ সালে সরকার পরিবর্তনের পর হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
রাজনৈতিক কারণ বলা হলেও এভাবে মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম ছিল বিতর্কিত। অভিযোগ রয়েছে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কবিহীন বহু অভিযুক্ত গুরুতর অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেয়ে যায় এ প্রক্রিয়ায়। তা ছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক ব্যক্তি বিদেশে পালিয়ে গিয়ে ব্যবসা করত। চারদলীয় জোট সরকারের সময় তাকে সমঝোতার মাধ্যমে ডেকে এনে কয়েক দিন জেলে রেখে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগে মুক্তি দেওয়া হয়। তেমনি ঘটেছে বর্তমান সরকারের সময়কালেও। রাষ্ট্রপতির এ সাংবিধানিক ক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকুক, তা আমরা চাই। তবে সেটার প্রয়োগ হোক নিরঙ্কুশ জনস্বার্থে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নয়। এ ধরনের কার্যক্রম অপরাধ জগৎকে সবুজ সংকেতই দিয়েছে।
পুলিশের দায়িত্ব পালনের সীমাবদ্ধতা আছে অনেক। তেমনি সীমাবদ্ধতা আছে সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোরও। আর সেগুলো পুলিশ থেকে ভালো চলছে এমনও বলা যাবে না। পুলিশের সীমাবদ্ধতা লোকবল, যানবাহন, আবাসনসহ অনেক বিষয়েই। সরকার এ বিষয়গুলো দূর করতে সক্রিয়, এমনটাই দেখা যায়। হয়তো সুফল পাওয়া সময়সাপেক্ষ।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, এ সংস্থাটির জনবল আর পদ-পদবি বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়ে চেলছে অপরাধীদের দাপট। একে মোকাবিলা করতে হলে পুলিশ বাহিনী স¤প্রসারণের পাশাপাশি তাদের উন্নততর প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে হবে। অপরাধের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। এসব তদন্তে প্রয়োজন উঁচু মানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুদক্ষ কর্মকর্তা। এখন পুলিশ বাহিনীতে মেধাবী কর্মকর্তা যথেষ্ট রয়েছেন। তাঁদের দেশ-বিদেশে উন্নততর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করা দরকার। আজকাল সিঁধ কেটে চুরি হয় না। টাকা চুরি হয় এটিএম বুথ থেকে, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে। সুতরাং তদন্তের ধরন ও তদন্ত কর্মকর্তার মানও একই পর্যায়ে নিতে হবে। আরেকটি বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমান আইনি কাঠামোতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। নতুন একটি আইনের খসড়াও রচিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, এ ধরনের আইন হলেই পুলিশ বাহিনী অনেক নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে। থাকতে পারে প্রচলিত আইনের সীমাবদ্ধতা। প্রয়োজন হতে পারে নতুন আইন প্রণয়নের। তবে আইন করে অফুরন্ত ক্ষমতা দিলেও প্রতিষ্ঠানটি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। দৃষ্টান্ত হিসেবে তো আমাদের সামনে দুর্নীতি দমন কমিশনই রয়েছে। সংবিধান ও বিভিন্ন আইনে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হলেও এটি সময় সময় মুখ থুবড়ে পড়েছে। নচেৎ এ দেশের বেশ কটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কথা ছিল না। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য বেশ কয়েকবারই নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয়েছে। সুতরাং বলা চলে কার্যকর আইনের প্রয়োজন আছে। তবে তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন সে আইনটি যাঁরা প্রয়োগ করবেন, তাঁদের মানসিকতা। পাশাপাশি সরকারের সদিচ্ছা।
আমরা আইনের শাসন চাই। আইনের দ্বারা গঠিত পুলিশ আইন প্রয়োগ করবে, এটাই চাই। সে গন্ডির বাইরে তারাও যেতে পারে না। হবিগঞ্জে চার শিশু হত্যা মামলার এক আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। এর আগে কেরানীগঞ্জে স¤প্রতি একটি হত্যা মামলার কুখ্যাত এক আসামি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধৃত হওয়ার পর ‘ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। ‘ন্যায়বিচার হয়েছে এবং এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে’ এই দাবিতে সেখানে মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটি আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ।


আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে আইন প্রয়োগের ভয়ে মানুষ তটস্থ থাকবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আইনের ভয়েই অপরাধ হতে দুরে থাকবে । আর পুলিশ হলো সেই আইনের বাস্তবায়নের ধারক ও বাহক।
এ ধরনের ঘটনা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমনটা আমরা চাই না। আমরা চাই শক্তিশালী, দক্ষ ও নিরপেক্ষ আর আইনের প্রতি অনুগত একটি পুলিশ বাহিনী। এর জন্য যা প্রয়োজন, সরকারের তাই করা দরকার ।
ক্রাইম ডায়রি//স্পেশাল