কঠোর সিদ্ধান্ত আসছে ৩৫ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সফটওয়্যার শপ লিমিটেড (এসএসএল), নগদ, ফস্টার করপোরেশন, বিকাশ এবং সূর্যমুখী পে লিমিটেডকে ব্যবহার করেছে। এসব পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার করে গ্রাহক তাদের পণ্য কেনার ক্ষেত্রে টাকা পরিশোধ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে গ্রাহকরা পণ্য কেনার ক্ষেত্রে এসএসএলের মাধ্যম ব্যবহার করে ২৭৪৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে।

কঠোর সিদ্ধান্ত আসছে ৩৫  প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে
ছবি-অনলাইন হতে সংগৃহীত
নির্ধারিত সময়ে যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়নি তাদের তালিকা করা হচ্ছে। এই তালিকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আগামী সপ্তাহে ই-কমার্সসংক্রান্ত সরকারের গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে আরও কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটি চূড়ান্ত করা হবে।
কালিমুল্লাহ দেওয়ান রাজাঃ
অনলাইন ভিত্তিক সেলস প্ল্যাটফর্ম ই-কমার্সের প্রতি গ্রাহকের অনীহা তৈরি হয়েছে আস্থার সংকট হতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে প্রতারণার মাধ্যমে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ৬ হাজার ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অদ্যবধি পর্যন্ত। অপরদিকে সরকার উদ্যোগ নিয়ে এ পর্যন্ত গ্রাহকের প্রায় ৫৭ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। বাকি অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সময় বেঁধে দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত সাড়া দেয়নি অভিযুক্ত  প্রতিষ্ঠানগুলো।
তাই এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। চলতি সপ্তাহে ই-কমার্সসংক্রান্ত সরকারের টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ই-কমার্স সেলের প্রধান সফিকুজ্জামান বলেন, নির্ধারিত সময়ে যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়নি তাদের তালিকা করা হচ্ছে। এই তালিকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আগামী সপ্তাহে ই-কমার্সসংক্রান্ত সরকারের গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে আরও কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটি চূড়ান্ত করা হবে।
ই-অরেঞ্জে ১১০০ কোটি টাকা, ই-ভ্যালি ১ হাজার কোটি টাকা, ধামাকা ৮০৩ কোটি টাকা, এসপিসি ওয়ার্ল্ড ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এছাড়া এহসান গ্রুপ ১১০ কোটি, নিরাপদ ডটকম ৮ কোটি, চলন্তিকা ৩১ কোটি, সুপম প্রোডাক্ট ৫০ কোটি, কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর বাইরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা গ্রাহকদের কাছ থেকে নীরবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ই-কমার্সের নামে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সুত্রে জানা গেছে,  সুযোগ দেওয়ার পরও যারা গ্রাহকদের আত্মসাৎ করা টাকা ফেরত দেয়নি যাবা তাদের বিরুদ্ধের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হয়তো টাকা ফেরত দেবে, নয়তো তারা জেলে যাবে। কোনো অবস্থায় প্রতারণাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে প্রায় ৩৫টি কোম্পানির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব কোম্পানি সরাসরি প্রতারণা করেছে গ্রাহকদের সঙ্গে। এখন সামনে টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠক হবে। সেখান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে এই তালিকা। এরপর তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবে তারা। প্রাথমিকভাবে একটি সিদ্ধান্ত হয়ে আছে।
 
বাণিজ্য মন্ত্রণলায়ের হিসাবে কমপক্ষে ৩৫টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের টাকা না দিয়ে আত্মগোপন করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আলাদিনের প্রদীপ, আদিয়ান মার্ট, নিডস, টুয়েন্টিফোর টিকিট ডট, ফাল্গুনি শপ ডটকম, গ্রিন বাংলা, নিরাপদ ডটকম, এহসান গ্রুপ, র‌্যাপিড ক্যাশ, চলন্তিকা ডটকম, কুইক অনলাইন, ই-লোন অ্যাপ, বাজাজ কালেকশন, এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড অ্যাগ্রো ফুড অ্যান্ড কনজ্যুমারস, সুপম প্রোডাক্ট, কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং ও আরএসটি ওয়ার্ল্ড। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে অনেকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। কেউ কেউ সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে, সেটি তারা আত্মগোপনে থেকে এবং নিজস্ব সোর্স দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে।
জানা যায়, বাংলাদেশের ই-কমার্স এবং ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসায়ীরা মাসে ৫০০ থেকে ৫৫০ কোটি টাকার লেনদেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে শুধু ২৫টি প্রতিষ্ঠানের কারণে লেনদেন বেড়ে দাঁড়ায় ৬০৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ই-অরেঞ্জে ১১০০ কোটি টাকা, ই-ভ্যালি ১ হাজার কোটি টাকা, ধামাকা ৮০৩ কোটি টাকা, এসপিসি ওয়ার্ল্ড ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এছাড়া এহসান গ্রুপ ১১০ কোটি, নিরাপদ ডটকম ৮ কোটি, চলন্তিকা ৩১ কোটি, সুপম প্রোডাক্ট ৫০ কোটি, কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর বাইরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা গ্রাহকদের কাছ থেকে নীরবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ই-কমার্সের নামে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণা বন্ধের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ নিলে সেই লেনদেন গত বছরের ১ জুলাই থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যান্ত নেমে এসেছে ৫০৬ কোটি টাকায়। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে দেওয়া হয় ৫৬১ কোটি টাকা। এরপর পেমেন্ট গেটওয়ে গ্রাহকের আটকে থাকা অর্থ ছাড় করার উদ্যোগ নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৫৭ কোটি টাকা ফেরত পেয়েছেন।
জানা যায়, সব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সফটওয়্যার শপ লিমিটেড (এসএসএল), নগদ, ফস্টার করপোরেশন, বিকাশ এবং সূর্যমুখী পে লিমিটেডকে ব্যবহার করেছে। এসব পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার করে গ্রাহক তাদের পণ্য কেনার ক্ষেত্রে টাকা পরিশোধ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে গ্রাহকরা পণ্য কেনার ক্ষেত্রে এসএসএলের মাধ্যম ব্যবহার করে ২৭৪৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে।
জানা যায়, ২০২০ সালের দিকে বাংলাদেশে ই-কমার্স বাজারের আকার ১৬৬ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমান প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে এ খাতে। ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের ই-কমার্স খাত ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে পৌঁছাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
 
কোভিড-১৯ মহামারিকালীন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে এই খাতের মোট উদ্যোক্তাদের মধ্যে মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ উদ্যোক্তা ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সাফল্য পেয়েছেন।
গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানিটির কাছে প্রায় ৮৯ কোটি টাকা আটকে ছিল। এর মধ্য থেকে ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত গ্রাহকদের প্রায় ১৫ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। এছাড়া মার্চ থেকে জুনের মধ্যে গ্রাহকরা মোবাইল ব্যাংকিং নগদের মাধ্যমে ১৮৪০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। বর্তমানে, প্রায় ২০ কোটি টাকা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা কোম্পানিটির কাছের আটকে আছে। পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান ফস্টার করপোরেশনের মাধ্যমে গ্রাহকরা পণ্য কেনার জন্য ৮২৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল। ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত গেটওয়ের কাছে প্রায় ৩৮৩ কোটি টাকা আটকে ছিল। এ প্রতিষ্ঠান ১৫ মার্চ পর্যন্ত গ্রাহকদের ৪২ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে।
এছাড়া দেশের সবচেয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে ৩৫২ কোটি টাকা পেয়েছে ই-কমার্স প্ল্যাটফরমগুলো। এখন প্রায় ৫ কোটি টাকা বিকাশের কাছে আটকে আছে। যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে-থলে ডটকম, আনন্দবাজার, উইকম ডটকম, বাংলাদেশ ডিল, আলেশা মার্ট, কিউকম, শ্রেষ্ঠ ডটকম, আলিফ ওয়ার্ল্ড, দালাল প্লাস, বুমবুম ডটকম ও ধামাকা ডটকম।
সূত্র আরও জানায়, গ্রাহকদের পক্ষ থেকে ১৫টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪১টি মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি হয়েছেন ১১০ জন এবং গ্রেফতার হয়েছেন এ পর্যন্ত ৩৬ জন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ ও রিং আইডি। এই মামলার মধ্যে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। তবে মামলাধীন থাকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে থাকা গ্রাহকের অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিষয়টি আদালতে নিষ্পত্তি হবে।
 
 ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-ক্যাবের সহসভাপতি শাহাবুদ্দিন শিপন। তাকে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি  জানান, গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার সময় দিয়ে যে সুযোগ সরকার দিয়েছে, এটি গ্রহণ করা উচিত ছিল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারত। এখন সরকার তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে, সেটি দেখে মন্তব্য করা যাবে। তবে ই-কমার্স খাতের ক্ষতি যেন না হয়, সেটি লক্ষ্য রাখার প্রতি তিনি মাননীয় সরকার বাহাদুরের প্রতি আহবান জানান।
ক্রাইম ডায়রি// আইন শৃঙ্খলা