সুগন্ধা নদী ট্রাজেডিঃ দূর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া জরুরী
লাশের মিছিল হতে কি শিক্ষা নেই আমরা? কি সতর্কতাই বা আমরা অবলম্বন করি? নদীপথে উদ্ধারকারী জাহাজের জোনভিত্তিক টহল জরুরি। যাতে দূর্ঘটনার বিশমিনিটের নোটিশে তারা সেখানে পৌঁছাতে পারে।
লঞ্চে থাকা শিশুদের আর্তনাদ বাতাসে ভেসে বেড়াবে অনন্তকাল। কর্তৃপক্ষও একসময় ভূলে যাবে এ করুণ পরিনতির কথা। হ্যা, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর ট্রাজেডির কথাই বলছি।
ঝালকাঠি হতে আমজাদ হোসেনঃ
এ যেন এক ভৌতিক ব্যাপার। মধ্যে রাতে হঠাৎই দাউদাউ করে জলছে আগুন। তাও আবার নদীর মাঝে। নদীতে যারা এ দৃশ্য দেখেছেন তারা প্রথমে ভৌতিক ব্যাপারই মনে করেছেন। যখন বুঝতে পেরেছে তখন লাশের মিছিল। তাছাড়া মাঝনদীতে উদ্ধারকারী জাহাজ কিংবা নিদেন পক্ষে জেলে নৌকাছাড়া কারই বা কি করার থাকে??
লঞ্চে থাকা শিশুদের আর্তনাদ বাতাসে ভেসে বেড়াবে অনন্তকাল। কর্তৃপক্ষও একসময় ভূলে যাবে এ করুণ পরিনতির কথা। হ্যা, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর ট্রাজেডির কথাই বলছি।
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত হয়েছেন কমবেশি ৭২ জন। তাদের বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ডিসেম্বর ২৩,২০২১ইং বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে প্রায় ৪০০ যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। চাঁদপুর ও বরিশাল টার্মিনালে লঞ্চটি থামে এবং যাত্রী ওঠানামা করেন। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পৌঁছলে রাত ৩টার দিকে এতে আগুন ধরে যায়।
পরে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের দিয়াকুল এলাকায় নদীর তীরে লঞ্চটি ভেড়ানো হয়। আগুন লাগার পরপরই লঞ্চ থেকে প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন যাত্রীদের অনেকেই। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নৌকা নিয়ে লঞ্চের আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। স্থানীয়রাও উদ্ধারে এগিয়ে আসে।
লঞ্চ থেকে লাফিয়ে প্রাণে বাঁচা কয়েকজন যাত্রী ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যাত্রী এবং তাদের স্বজনরা জানান, হঠাৎ রাত ৩টার দিকে লঞ্চে আগুন লাগে। ইঞ্জিনরুম থেকে আগুন দ্রুত পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখা ও ধোঁয়ায় পুরো লঞ্চ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এ সময় লঞ্চের ডেকে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। প্রাণ বাঁচাতে অনেকে নদীতে ঝাঁপ দেয়।
যারা কেবিনে ঘুমিয়ে ছিলেন, তারা চিৎকার শুনে বের হয়ে চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। ধাক্কাধাক্কি ও পদদলিত হয়ে অনেকে আহত হয়। পুরো লঞ্চের যাত্রীরা ডাক-চিৎকার আর আর্তনাদ করতে থাকে। যে যেভাবে পেরেছে নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছে।
অনেকে স্বজনদের রেখেই ঝাঁপ দিয়েছে নদীতে।অনেকেই বেঁচে ফেরার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন একপর্যায়ে। বাবা মায়ের দৃশ্য ছিল আরও করুণ। সাতার না জানা শিশুকে রেখে কিভাবে প্রাণ বাঁচাবেন? আবার অনেক স্বামী-স্ত্রীরাও এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলেন। শেষমেশ বিধাতার ওপর ভরসা রেখে অনেকেই ঝাঁপ দেন নদীতে। কেউ কেউ বেঁচে ফিরলে, পারেননি অনেকে।
বেঁচে ফেরা এক যাত্রী জানান, পোড়া গন্ধ পেয়ে কেবিন থেকে আমি বেরিয়ে দেখি লঞ্চে আগুন লেগেছে। এ সময় স্ত্রী ও শ্যালককে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিই। প্রচণ্ড ঠান্ডায় নদী সাঁতরে তীরে উঠতে পেরেছি আমরা।
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ ঢাকা থেকে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে। তিনি ছিলেন লঞ্চের ভিআইপি কেবিনে। তিনি হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেয়ে বের হয়ে দেখেন আগুন লেগেছে। উপায় না পেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন তিনি। তবে ঝাঁপ দেওয়ার সময় তার স্ত্রীর একটি পা ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে। এসময় তিনিও সামান্য আহত হয়েছেন। তবে প্রানে বেঁচে যাওয়ায় তিনি মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
ইউএনও সাংবাদিকদের জানান, ‘রিভার ভিউয়ের দিকে কেবিনে যেসব যাত্রী বসা ছিল, তারা অনেকেই বের হতে পেরেছে। যাদের কেবিন লঞ্চের মাঝখানে ছিল, তাদের অনেকেই ধোঁয়ার কারণে বাইরে বের হতে পারেনি।’
শীতের রাতের লঞ্চ ভ্রমণ, তার ওপর আবার কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ। যারা কেবিনে ছিলেন তাদের বেশিরভাগই ঘুমিয়েছিলেন। এ ছাড়া শীতের কারণে অন্য যাত্রীরাও গরম কাপড়ে শরীর মুড়ে ঘুমিয়ে ছিলেন । গভীর রাতপ হঠাৎ বিস্ফোরণের পর আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে সবাই আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন লঞ্চের কেবিন বয়।তার নাম নোঃ ইয়াসিন আলী। বয়স প্রায় বিশ বছর। সে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানায়, লঞ্চের নিচতলার পেছনে ইঞ্জিনরুমের পাশেই ক্যান্টিন। সেখানে বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে লঞ্চে আগুন ধরে যায় এবং তা দ্রুত ইঞ্জিনরুমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে রাখা ১৩ ব্যারেল ডিজেল আগুন বাড়িয়ে দেয়। ইঞ্জিনরুম থেকে আগুন চলে যায় ডেকের দিকে বলে সে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানায়।
প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রীদের একজন জানান, লঞ্চের ডেকের জানালার পর্দায় আগুন লেগে তা দোতলায় ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে প্রথমে পারটেক্স বোর্ডের সিলিংয়ে আগুন লাগে। দোতলায় একটা চায়ের দোকান ছিল। ওই দোকানের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে আগুন আরও তীব্র হয়। এভাবে পুরো লঞ্চটি আগুনে পুড়ে যায়।
অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক হানজালা গণমাধ্যমকে বলেন, লঞ্চের কেরানি আনোয়ার রাত ৩টা ৫ মিনিটে তাকে ফোন করে আগুন লাগার খবর দেন। সে বলেছে দোতলায় একটা বিস্ফোরণ হয়, সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে আর লঞ্চের পেছনের বিভিন্ন অংশে আগুন দেখা যায়। তার পর তৃতীয় তলার কেবিন ও নিচতলায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ওই লঞ্চে অন্তত ২১টি তেলের ব্যারেল ছিল বলে জানা গেছে।
ক্রাইম ডায়রি // জাতীয়