অনুমতি ছাড়াই চলছে কয়েক হাজার ব্রান্ডের কয়েল-নিশ্চুপ কর্তৃপক্ষ

অনুমোদন ছাড়াই গড়ে ওঠা এসব কারখানায় সরকারের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যেই অভিযান চালানো হয়। এর পরও অজ্ঞাত কারণে আইনের ফাঁক-ফোকরে বেঁচে যায় অবৈধ কয়েল কোম্পানির মালিকরা। কয়েলের ধোঁয়ায় দ্রুত মশা মরলেও এটি মানবদেহের জন্য বেশি ক্ষতিকারক। আবার কেউ কেউ মনে করেন ধোঁয়াবিহীন মশার কয়েলে তেমন সমস্যা নেই। তাদের জন্য জানা দরকার, এসব কয়েল থেকে বিশাল পরিমাণ কার্বন মনোক্সাইড নির্গত হয়, যা ফুসফুসের জন্য ভয়ানক। 

অনুমতি ছাড়াই চলছে কয়েক হাজার ব্রান্ডের কয়েল-নিশ্চুপ কর্তৃপক্ষ
ছবি- অনলাইন হতে সংগৃহীত

তবে অবৈধ মশার কয়েল বন্ধে বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী ভুমিকা রেখেছে বিএসটিআই বগুড়া। টিম ক্রাইম ডায়রির নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে ‍ বগুড়ায় একটি মাত্র অবৈধ কারখানা ছিল। যেখানে বগুড়া বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তা প্রকৌশলী জুনায়েদ আহমেদ একাধিকবার অভিযান চালিয়ে জড়িমানা, নিয়মিত মামলা রুজু ও অবৈধ পণ্য ধ্বংস করেছেন। ফলে বগুড়া জেলায় অবৈধ কয়েল কারখানা নেই।

কালিমুল্লাহ দেওয়ান রাজাঃ

কোন অনুমোদন নেই। অনুমোদনের চিন্তা আদৌ তারা করেন না। অনেক বেশি লাভজনক হওয়ায় প্যাকেট ব্রান্ড আর কারখানা কন্টাক করেই বাজারজাত চলছে হাজারো ব্রান্ডের কয়েলের। রাজধানীর কয়েলপাড়া খ্যাত মাতুয়াইল,যাত্রাবাড়ির কিছু অংশ, দনিয়া, জুরাইন ও চিটাগাং রোড এলাকায় রয়েছে নাম জানা না জানা ঘরে ঘরে অসংখ্য কয়েল ফ্যাক্টরী। যাদের সিংহ ভাগেরই নেই কোন কাগজপত্র। আবার অনেকে ভুয়া পিএইচপি নম্বর দিয়ে কিংবা একই পিএইচপি নম্বর ব্যবহার করে অনেক কোম্পানীর পণ্য বানিয়ে দিচ্ছেন দেদারসে। 

বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই জানেন না আসলে কিকি ধরনের কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় বৈধ কয়েলের ব্যবসা করতে। তাদের বেশিরভাগই ব্রান্ডের বড় কোম্পানী গুলো বাদে কন্টাক ম্যানুফ্যাকচারিং করেন ষ্ট্যাম্পে ডিড করে কিন্তু আদৌ তারা জানেন না এই ডিডের আসলেই কোন মূল্য  আছে কিনা। এর ফলে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকিতে পড়ছে সরকার।

মশার কয়েলের ব্যবসা করতে হলে পিএইচপিই যথেষ্ট নয় প্রয়োজন বিএসটিআইয়ের মেট্রোলজি এবং সি এম লাইসেন্স এর। প্রয়োজন পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন এবং আনুসাঙ্গিক অন্যন্য ডকুমেন্টস এর।

উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে মশার কয়েল তৈরি করছে নামসর্বস্ব অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এসব কারখানার অনুমোদনও নেই। রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় এমন কারখানার সংখ্যা অন্তত ৪০।

নীতিমালা অনুযায়ী, মশা মারার জন্য নয় বরং মশা তাড়াতে কয়েল উৎপাদন ও ব্যবহারের কথা। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে অবৈধ কয়েল প্রস্তুতকারকরা। উচ্চমাত্রার রাসায়নিক প্রয়োগের কারণে নিমিষে মশা মরে যাওয়ায় অসচেতন ক্রেতা ওই কয়েল ব্যবহার করছেন। আর বেশি লাভের আশায় খুচরা বিক্রেতারাও এসব কয়েল দোকানে রাখছেন।

কিন্তু অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের বিষাক্ত কয়েল প্রস্তুত ও বাজারজাত বন্ধ করার ক্ষেত্রে দেশের পণ্যের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নেই। যদিও বিএসটিআই বলছে, তারা অভিযান চালালে ওই সব কারখানা মালিক কারখানা সরিয়ে নিয়ে যায়। তবে তিনজন মালিক দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, অবৈধ হলেও তারা প্রভাবশালী সবপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে কারখানা চালাচ্ছেন।

টিম ক্রাইম ডায়রির অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর চকবাজারকে ঘিরে নকল পণ্য তৈরির অসংখ্য কারখানা। কোনোটিতেই সাইনবোর্ড নেই। কোনো কোনো ভবনের গেটে ‘প্রবেশ নিষেধ’ লেখা সাইনবোর্ড। এমন একটি বাড়ির নিচতলায় ঢুকে দেখা যায়, আলো জ্বলছে নিভু নিভু। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। আট থেকে বারো বছরের অনেক শিশু কয়েল তৈরির কাজে ব্যস্ত। পাশেই পড়ে আছে তুলসি পাতা, লিজার্ড, অ্যাকশন, ম্যাক ফাইটার, পরিমা, দাদাগিরি, রয়েল কিংসহ অসংখ্য  নামের কোম্পানির মোড়ক।

শিশু শ্রমিকদের দিয়ে মাত্রারিক্ত বিষাক্ত ডি-এলেথ্রিন কিংবা অন্য কোন বিষ মিশিয়ে তৈরি হয় নিম্নমানের কয়েল। পরে তা বিভিন্ন মোড়কে ভরে বাজারে ছাড়া হয়, যা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্রতিটি প্যাকেটের গায়েই আবার ‘বিএসটিআই’র সিল! অথচ কারখানাটিরই কোনো অনুমোদন নেই।

এ দৃশ্য শুধু চকবাজার নয় বরং কেরানিগঞ্জ, কামরাঙ্গীর চর, দনিয়া, শনিরআখরা, মাতুয়াইল, চিটাগাং রোড, ভৈরবসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ফ্যাক্টরীর। এদের কারো কারো বা পিএইচপি লাইসেন্স আছে কিন্তু নেই বিএসটিআইয়ের অনুমোদন। আবার কারো অনেক কিছুই আছে  কিন্তু পরিবেশই বলে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নেই। আবার কারো তা যদি আদৌ থাকে তবে মনে প্রশ্ন জাগে পরিবেশ ছাড়পত্র এরা কোন আইনের বলে পেয়েছে?

বিশেষজ্ঞরা জানান, কয়েলের কাজ মশা তাড়ানো, মেরে ফেলা নয়। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে কয়েলে সর্বোচ্চ ০.০৩ মাত্রার ‘অ্যাকটিভ ইনগ্রিডিয়েন্ট’ ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। মশা তাড়ানোর জন্য এ মাত্রাই যথেষ্ট কার্যকর। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অনুমোদন ছাড়াই উৎপাদন ও বাজারজাত করা কয়েলে শুধু মশাই নয়; বিভিন্ন পোকামাকড়, তেলাপোকা এমনকি টিকটিকিও মারা যায়।

আর এতেই বোঝা যায়, এসব কয়েলে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি হারে ‘অ্যাকটিভ ইনগ্রিডিয়েন্ট’ ব্যবহৃত হচ্ছে; যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।মশার কয়েলে কী মাত্রার রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে তার একটি মান ঠিক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটির হিসাবে মশার কয়েলে সর্বোচ্চ দশমিক ৩ মাত্রার রাসায়নিক ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু দেশের অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো তার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশের একটি কয়েল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দেশের বাজারের অখ্যাত ১৪টি ব্র্যান্ডের মশার কয়েল পরীক্ষার জন্য ভারতে পাঠায়। এতে দেখা যায়, এসব কয়েলে মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ১৪ গুণ বেশি রাসায়নিক ব্যবহৃত হচ্ছে। এর আগে ২০১৫ সালে, জাপানের সুমিতমো কেমিক্যালের কাছেও ২৪টি কয়েলের নমুনা পাঠানো হয়েছিল পরীক্ষার জন্য। তাতেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হারে এবং আইন ভেঙে একাধিক রাসায়নিক ব্যবহারের চিত্র পাওয়া যায়। 

দেশে মশা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। ক্রাইম ডায়রিকে তিনি বলেছেন, ‘গবেষণায় আমরা দেখেছি অনিবন্ধিত মশার কয়েলে এগ্রিকালচারাল পেসটিসাইড-এপি (কৃষিকাজে ব্যবহৃত কীটনাশক) উচ্চমাত্রায় রয়েছে। এই কীটনাশক মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। মশার কয়েলে পাবলিক হেলথ পেসটিসাইড (পিএইচপি) বা মানবস্বাস্থ্যের জন্য সহনীয় কীটনাশক ব্যবহার করার কথা।’ তিনি বলেন, অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠানের যেহেতু জবাবদিহি নেই তাই তারা পিএইচপির কথা বলে এপি ব্যবহার করে। আমরা দীর্ঘদিন এসবের বিরুদ্ধে বলে আসছি। কিন্তু কাজ হয় না।’ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, যে কয়েলে মশা মরে সেই কয়েলে মানুষও অসুস্থ হবে, বিশেষ করে বাচ্চারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

রাজধানীর চাঁদ উদ্যানের ডোবার ওপর গড়ে ওঠা একটি কয়েল কারখানার বিরুদ্ধে গত বছর অভিযান চালায় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই কারখানার তৈরি কয়েল চারটি নামে এখন বাজারে পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে লামিয়া নিমপাতা, লামিয়া হাই বুস্টার, লামিয়া জাম্বু ও লামিয়া লাল হিট।

এই কয়েল ব্যবহারের কারণে এক ব্যক্তির শিশুসন্তান ও অন্যজনের কবুতর মারা যাওয়ার অভিযোগ পেয়ে বিএসটিআই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। বৈধ কাগজপত্র দেখাতে না পারায় কারখানাটিকে এক লাখ টাকা জরিমানা ও কারখানাসহ দুটি গোডাউন সিলগালা করে দেওয়া হয়।

 কোম্পানিগুলোর মোড়কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সকল সংস্থার অনুমতি , নম্বর এবং কোড সব ঠিকঠাকই উল্লেখ থাকে। যদিও এগুলোর কোন দলিল নেই। জানা গেছে, এসব কয়েল ব্যবহারে হতে পারে শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালিতে প্রদাহ, কিডনিতে জটিলতা, ক্যান্সার, চোখে সমস্যাসহ অনেক রোগ। নারীদের গর্ভস্থ শিশুরও বিকলাঙ্গতাসহ মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, কয়েলে সহনশীল মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহারে ক্ষতির আশঙ্কা অনেক কম। তবে অধিকাংশ কোম্পানি তা না মানার কারণে নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ব্যবহারকারীরা। অবাক হলেও সত্য, কয়েকটি কারখানার মালিক জানান, বেশি রাসায়নিক না দিলে মশা মরে না!

কাঁচামালে টেনারি বর্জ্য

রাজধানীর টেনারিগুলোতে প্রক্রিয়াজাতকরণ চামড়া থেকে গড়ে প্রতিদিন ৮০০ মিলিয়ন লিটারের মতো অপরিশোধিত বর্জ্য নির্গমন হয়। আর এসব সস্তা বর্জ্য থেকেই তৈরি হচ্ছে মশার কয়েলের কাঁচামাল। এতে উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয়। এক বস্তা বর্জ্যে তৈরি হয় ৪০০ পিস কয়েল। ফরমালিন-আর্সেনিকের মতোই এসব রাসায়নিক দ্রব্যের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।

অনুমোদন ছাড়াই গড়ে ওঠা এসব কারখানায় সরকারের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যেই অভিযান চালানো হয়। এর পরও অজ্ঞাত কারণে আইনের ফাঁক-ফোকরে বেঁচে যায় অবৈধ কয়েল কোম্পানির মালিকরা। অথচ বালাইনাশক অধ্যাদেশ (পেস্টিসাইড অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ ও পেস্টিসাইড রুলস ১৯৮৫) অনুসারে, মশার কয়েল উৎপাদন, বাজারজাত ও সংরক্ষণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। এর পর পাবলিক হেলথ প্রোডাক্ট (পিএইচপি) নম্বর ও বিএসটিআইর অনুমতি নিয়েই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হয়।

 ১৩৭ সিগারেটের সমান ক্ষতি করে একটি কয়েল-

জানা যায়, আবদ্ধ ঘরে টানা ৮ ঘণ্টা জ্বালিয়ে রাখলে সামান্য একটি মশার কয়েলের ধোঁয়া ১৩৭টি সিগারেটে থাকা নিকোটিনের চেয়েও ক্ষতিকর। তা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়া কয়েলে জড়িয়ে থাকা গুঁড়া এতটাই সূক্ষ্ম যে, তা সহজেই শ্বাসনালি এবং ফুসফুসের পথে গিয়ে জমা হয়ে বিষাক্ততা তৈরি করে। এক সময় তা ব্রেন ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া কয়েলের ধোঁয়া চোখের ভীষণ ক্ষতি করে, দীর্ঘদিন ব্যবহারে তা নষ্টও হয়ে যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, কয়েল ব্যবহার করে মশা মারতে গিয়ে ফুসফুসের ক্যান্সারের সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। এ বিষয়ে জার্মানির ল্যুরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তারা জানান, কয়েল তৈরিতে যে কাঠের ও নারিকেলের মালার গুঁড়া ব্যবহার হয়, তার ধোঁয়া এতই সূক্ষ্ম যে, তা সহজেই আমাদের শ্বাসনালি ও ফুসফুসের বায়ুথলির মধ্যে পৌঁছে জমা হতে পারে। এমনকি সূক্ষ্ম কণাগুলো কয়েকদিন বাতাসেও ভাসমান অবস্থায় থাকতে পারে। অর্থাৎ, মশার কয়েল নেভানোর বহু সময় পরেও ঘরে অবস্থানকারীর শ্বাসনালিতে তা ঢোকার সম্ভাবনা থাকে। এটা পরিবেশে মিশে যাওয়ায় প্রাণীরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। তাছাড়া সব মশার কয়েলেই থাকে অ্যালেথ্রিন, যা মস্তিষ্ক ও রক্তের স্বাভাবিক তৎপরতা ব্যহত করে।

কয়েল মারাত্বক ক্ষতি করে প্রজনন স্বাস্থ্যের 

মশা যেমন জটিল রোগের জীবাণু বাহক, তেমনি এ কীট নিধনের কয়েলও শিশু ও মায়ের জন্য ক্ষতিকর। এতে ব্যবহৃত সব কেমিক্যালই মানবস্বাস্থ্যের ধ্বংস ডেকে আনে। গর্ভাবস্থায় যেসব মা মশা তাড়াতে কয়েল ব্যবহার করেন, তাদের শিশুরা ভবিষ্যতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বড় হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিডনি, শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যা দেখা দেয়। শরীরে বাসা বাঁধে নানা রোগ। এমনকি গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গও হয়ে যেতে পারে। 

এ বিষয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নওশিন শারমিন পূরবী বলেন, ‘অতিরিক্ত মাত্রার বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে তৈরি মশার কয়েল প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এসব কয়েলের ধোঁয়া মশা মারছে ঠিকই, কিন্তু তা মানুষের প্রজনন ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে গর্ভপাতের হার। পুরুষের শুক্রাণু কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে প্রিম্যাচিউরড বাচ্চার জন্মহার।’ 

ক্যান্সারের ঝুঁকিতে কয়েল শ্রমিকরা

কয়েল কারখানার শ্রমিকদের ঝুঁকি আরো মারাত্মক। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মশার কয়েল তৈরি করতে গিয়ে তারা কতটা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে মূল্যবান শ্রম বিনিয়োগ করছে, তা নিজেরাই জানে না। চীনে এমন একটি কারখানায় দেখা গেছে, ৫ বছরের মধ্যে সব শ্রমিকের ক্যান্সার হয়েছে। কারণ কয়েলে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, তার অনেকগুলো কখনো ধ্বংস হয় না। ছাই পানিতে মেশে সেটা আবারো মানুষের শরীরে আসার সম্ভাবনা থাকে।

আর দেশে অনুমোদনহীন কারখানাগুলোতে কম পারিশ্রমিকে শিশুদের দিয়েই বিষাক্ত কেমিক্যাল ও দ্রব্য মিশিয়ে কয়েল তৈরি করা হয়। মাতুয়াইলের একটি দড়জা বন্ধ ফ্যাক্টরীর শিশু শ্রমিককে বাহিরে এনে কথা হয় প্রতিবেদকের সাথে। নাম সিয়াম।  তার বাড়ি বরিশাল। অভাবের সংসার, খেয়ে-পরে বাঁচতেই কয়েল কারখানায় কাজ নিয়েছে শিশু সিয়াম। তবে এ পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে প্রায় সময়ই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুধু সিয়ামই নয়, এ অবস্থা প্রায় সব শ্রমিকেরই।

শীতকালে মশার প্রকোপ বাড়ে। তাই অনেকেই এদের হাত থেকে বাঁচতে বদ্ধ ঘরেই মশার কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমান। এটা শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ এ রকম ক্ষেত্রে ঘর থেকে দূষিত হাওয়া বেরিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না। ফলে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কমে গিয়ে ঘুমের মধ্যেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এতে মৃত্যুর ঘটনাও নেহাত কম নয়।

কিছুদিন আগে, চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকায় একটি আবাসিক হোটেলের রুমে মশার কয়েলের ধোঁয়ায় মৃত্যু হয় খোকন দত্ত নামে এক প্রৌঢ়ের। আসলে যেসব মশার কয়েলে ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে মশা মারা যায়, ভোক্তারা সেই কয়েলেরই ব্যবহার বেশি করেন।

অথচ তারা জানেন না, কয়েলের ধোঁয়ায় দ্রুত মশা মরলেও এটি মানবদেহের জন্য বেশি ক্ষতিকারক। আবার কেউ কেউ মনে করেন ধোঁয়াবিহীন মশার কয়েলে তেমন সমস্যা নেই। তাদের জন্য জানা দরকার, এসব কয়েল থেকে বিশাল পরিমাণ কার্বন মনোক্সাইড নির্গত হয়, যা ফুসফুসের জন্য ভয়ানক। 

এছাড়া দেশে চীন থেকেও প্রচুর পরিমাণে মশার কয়েল আমদানি হচ্ছে। চীনারা খুব কম মূল্যে যে কোনো পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করে। এসব পণ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কি না, সেটা নিয়ে তারা ভাবে না। অথচ উন্নত দেশে রপ্তানিকৃত চীনা পণ্য পরীক্ষার মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়।’

ক্রাইম ডায়রির এক প্রশ্নের জবাবে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘কয়েলের ধোঁয়া থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড বের হয়, যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটা গর্ভবতী নারী ও শিশুর বেশি ক্ষতি করে। সাধারণ মানুষের শ্বাসতন্ত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে। এছাড়া গর্ভপাতের মতো ঘটনাও ঘটে। শুধু তাই নয়, একটি মশার কয়েল থেকে যে পরিমাণ ধোঁয়া বের হয়, তা একশটিরও বেশি সিগারেটের ক্ষতির সমান। এতে ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা, হাঁপানি, এলার্জি ও স্তন ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।’ 

তবে অবৈধ মশার কয়েল বন্ধে বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী ভুমিকা রেখেছে বিএসটিআই বগুড়া। টিম ক্রাইম ডায়রির নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে ‍ বগুড়ায় একটি মাত্র অবৈধ কারখানা ছিল। যেখানে বগুড়া বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তা প্রকৌশলী জুনায়েদ আহমেদ একাধিকবার অভিযান চালিয়ে জড়িমানা, নিয়মিত মামলা রুজু ও অবৈধ পণ্য ধ্বংস করেছেন। ফলে বগুড়া জেলায় অবৈধ কয়েল কারখানা নেই। এছাড়া দেশের অনেক জেলাতেই বিএসটিআইয়ের অভিযানে অবৈধ কয়েল কারখানাগুলো আতংকে থাকে। কিন্তু তবুও থেমে  নেই এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা। 

অবৈধ কারখানায় গেলে দেখা যায় সেখানে শুধু প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় । তবে  কার্যালয়ে কাউকে পাওয়া যায়না। রাজধানীর চাদ উদ্যানের  একটি ফ্যাক্টরীতে একবার এমন হয়েছিল। একজন গণমাধ্যমকর্মী ঠিকানা নিয়ে সেখানে দেখতে গেলে স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, বিএসটিআইয়ের চোখ ফাঁকি দিতে কারখানাটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কেরানীগঞ্জে। এই গোপন ঠিকানা থেকে প্রতি রাতে পিকঅ্যাপ ভ্যানে করে কয়েল পাঠানো হয় ঢাকার চকবাজারে। এই চকবাজারেই রয়েছে অবৈধ কয়েল বাজারজাতকরণের শক্তিশালী চক্র। তারাই এসব ক্ষতিকারক কয়েল সারা দেশে দোকানে দোকানে সরবরাহ করে।

লামিয়া ব্র্যান্ডের কয়েল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহাম্মদ শামসুদ্দীন। তিনি ক্রাইম ডায়রির কাছে স্বীকার করেছেন যে ১০ বছর আগেও ঢাকার মৌলভীবাজার ও চকবাজার এলাকায় ঠেলাগাড়ি চালাতে তিনি। মাথায় করে পণ্য পৌঁছে দিতেন দোকানে দোকানে।  শামসুদ্দীন জানিয়েছেন, চকবাজারে থাকতেই তিনি পরিচিত হন অবৈধ কয়েল তৈরি ও বাজারজাত করার চক্রের সঙ্গে। এরপর ২০১১ সালে চালু করেন কয়েল তৈরির কারখানা। বর্তমানে কয়েল ব্যবসা থেকে বছরে অন্তত ৫০ লাখ টাকা লাভ হয় তার।  এখন তার কারখানা কোথায় জানতে চাইলে দুই ধরনের তথ্য দেন শামসুদ্দীন। প্রথমে বলেন, ঢাকার কেরানীগঞ্জে। পরে বলেন, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। তিনি বলেন, ‘বেশি রাসায়নিক না দিলে মশা মরে না আর মশা না মরলে মানুষ কয়েল কেনে না।’

ক্রাইম ডায়রির এক প্রশ্নের জবাবে বগুড়া বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তা প্রকৌশলী জুনায়েদ আহমেদ ক্রাইম ডায়রিকে বলেন, বার বার এসব অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় কিন্তু  জেল হতে বের হয়ে এসে এরা পুনরায় একই অপরাধে লিপ্ত হয়। তিনি বলেন, তথ্য পেলে সারা বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় বিএসটিআই অভিযান চালিয়ে অবৈধ কয়েল কারখানা বন্ধ করতে বদ্ধ পরিকর। তিনি বলেন, নিয়মিত মার্কেট মনিটরিং করা হচ্ছে কোন অবৈধ পণ্য দৃষ্টিগোচর হলে সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর বিরুদ্ধে একশন নেয়া হয়।

ক্রাইম ডায়রির এক প্রশ্নের জবাবে অপরাধ বিশেষজ্ঞ হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রচুর লাভজনক হওয়ায় এবং উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় এসব অপরাধীরা অবৈধ উৎপাদনে বারবার ফিরে আসছে। 

অবৈধ কারখানা ও ব্রান্ড বন্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ জেল, জড়িমানা ও সিলগালাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন স্থায়ীভাবে ফ্যাক্টরী সিলগালা ও উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। তাতে সরকার যেমন একদিকে প্রচুর রাজস্ব পাবে অন্যদিকে ভোক্তারাও পাবে উপযুক্ত পণ্যে। বৈধ কোম্পানী গুলো ব্যবসা করতে উৎসাহিত হবে।

 বিএসটিআই সুত্রে জানা গেছে, ্ঢাকা বিভাগে (ফরিদপুর ছাড়া) ৩৭টি ব্র্যান্ডের মশার কয়েল উৎপাদন, বাজারজাত ও সংরক্ষণ করতে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাই। কিন্তু তারা ঠিকানা পরিবর্তন করে আবার একই অপকর্ম চালায়। ফলে তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না।’

 রাসায়নিক পণ্য তৈরিতে বিএসটিআই থেকে অনুমোদন পাওয়ার আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) থেকে অনুমোদন পেতে হয়।কয়েল উৎপাদনের জন্য দেশে এখন ১৭টি রাসায়নিক পদার্থ আমদানি হয়। এগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী সর্বোচ্চ দশমিক ৩ মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।

 বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে সুপার ডিসকভারি, মাছরাঙ্গা, সোনালী কিং, প্যাগোডা গোল্ড, তুলসী পাতা, সুপার ফিলিপস ডিআইএম জাম্বু, অ্যাটাং কিং  সেইফ গার্ড, এক্সট্রা হাই পাওয়ার লিজার্ড মেগা, বস সুপার, টাটা হাই স্পিড, মেট্রো, সুপার জাদু, মাছরাঙ্গা কিং, সুপার সান পাওয়ার, এ-জেড মেঘনা, মারুফ পাওয়ার ম্যাজিক, পোলার, মাছরাঙ্গা মেঘাসহ বিভিন্ন নামে কয়েল উৎপাদন ও বিক্রি চলছে। এসব কয়েলের কারখানা রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ঢাকার সাভার, কামরাঙ্গীরচর, গাজীপুরের টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে।

দেশের সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাহারি নামের নানা ধরনের মশার কয়েল অনেকটা অবাধেই বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন পাড়া মহল্লার দোকানপাটে। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকসমৃদ্ধ এসব কয়েলের অধিকাংশেরই বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেই। কিন্তু আমরা তো অনুমোদনের বাইরে যেতে পারবো না, চাইলেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কয়েল বাজারে ছাড়তে পারি না। এক্ষেত্রে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তাই ধীরে ধীরে আমাদের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বড় বড় অনেক প্রতিষ্ঠানতো কারখানাই বন্ধ করে দিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। এখন আসলে কয়েলের বাজারে দুষ্টদের রাজত্ব চলছে।

ক্রাইম ডায়রি/ক্রাইম