বিপন্ন পরিবেশ: সংকটে সভ্যতা

নদীদূষণ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। অথচ কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে সংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানার বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করেই দায়িত্ব শেষ করছে।

বিপন্ন পরিবেশ: সংকটে সভ্যতা
ছবি-ক্রাইম ডায়রি

সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরের বর্জ্যে ধলেশ্বরী নদীর পানিসহ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ধলেশ্বরীর সঙ্গে বংশী, বুড়িগঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি নদীর সংযোগ রয়েছে। এ কারণে ওই সব নদীও মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে।

শরীফা আক্তার স্বর্নাঃ

প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পরিবেশ। নদী-নালা,খালবিল দুষণ ও দখল, বন দখল ও উজার, যত্রতত্র কলকারখানা, পরিকল্পনাহীন  নগরায়ন সবকিছু এ পরিবেশকে গ্রাস করে মানবসভ্যতাকে ঠেলে দিচ্ছে ভয়াবহ সংকটের দিকে।  পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে বিরাজমান নিবিড় যোগসূত্র সৃষ্টির শুরু থেকেই পরিবেশের সঙ্গে প্রাণীর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার ওপরেই নির্ভর করে আসছে। পরিবেশকেই জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার, জীবনীশক্তির ধারক-বাহক এবং ভবিষ্যতের আশ্রয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যা প্রতিকূল হলে মানুষসহ অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী-জীবনের বিকাশ হবে বাধাগ্রস্ত এবং জীবের ধ্বংস ও বিনাশ হবে অবশ্যম্ভাবী।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, ওজোনস্তরের ক্ষয়, প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার, পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়ন, নিঃশেষিত ভূগর্ভস্থ জ্বালানি ও পানির পরিমাণ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ এবং অতি আধুনিকতার জেরে গোটা পৃথিবীজুড়েই প্রতিনিয়ত পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে মানবসভ্যতাকে পরিবেশগত বিশাল সংকটের মধ্যে পড়তে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পরিবেশগত এ সংকট আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জন্য আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
এসডিজির ২৪১টি নির্দেশনার মধ্যে ২৫টিই পরিবেশ সংক্রান্ত; অথচ জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্কের প্রতিবেদন ২০২১ অনুযায়ী, এসডিজি অর্জনে ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১০৯, ১২০ ও ১২৯তম। বিগত প্রায় এক শতাব্দীতে কয়েকশ প্রজাতির প্রাণী ও গাছপালা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে নির্মল ও বিশুদ্ধ বাতাস, শুদ্ধ ও সুপেয় পানি, মাটির উর্বরাশক্তি, সবুজ ভূমি, বিস্তীর্ণ অরণ্য, অবারিত গাছপালা, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য, তাপমাত্রা ও বৃষ্টির মৌসুমগত পরিচালন ইত্যাদি। সাম্প্রতিক সময়ে করোনা অতিমারি আমাদের উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে অক্সিজেন গ্রহণের মূল্য এবং বেঁচে থাকার জন্য তার অপরিহার্যতা।

বর্তমানে যুবক থেকে বৃদ্ধ, ছাত্রছাত্রী, শিশু-কিশোর সবার কাছেই শব্দদূষণ এক অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। বাসস্ট্যান্ড, মাঠ-ঘাট, এমনকি স্কুলের পাশেও উচ্চৈঃস্বরে মাইক বাজানো হচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন নগরীতে, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও উৎপাদিত শব্দসহনীয় মাত্রা ৫০ ডেসিবেলের অনেক ওপরে। ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২-নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ প্রতিবেদনে দেখা যায়, শব্দদূষণের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান প্রথম এবং তালিকার শীর্ষ ৫ শহরের মধ্যে রাজশাহী চতুর্থ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদন ২০২০-এ দেখা যায়, ২০১৭ সালে পিএম ২.৫-এর কারণে বাংলাদেশে প্রায় ৬৪ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গ্রিন পিসের বায়ুদূষণ প্রতিবেদন ২০২১ অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম, আর সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে ঢাকা তৃতীয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-২০১৯ পর্যন্ত সারা দেশে ৫৯ শতাংশ ইটভাটা বেড়েছে এবং সংখ্যায় ৪ হাজার ৯৫৯টি থেকে ৮ হাজার ৩৩টি হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৩৭টির পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি নেই। পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই ২ হাজার ৫১৩টির এবং কোনোটিই নেই প্রায় ৩ হাজার ইটভাটার।

শুধু ঢাকা জেলাতেই আছে ৪৮৭টি ইটভাটা, যা ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশের উৎস হিসাবে ভূমিকা রাখছে। এসব ইটভাটা থেকে মাটি পোড়ানো ধোঁয়ায় পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ, বন উজাড় ও ভূমিক্ষয়ের প্রভাবে জীবকুলের নানাবিধ ক্ষতি ও রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও শিল্পায়নে ব্যবহৃত ইটের প্রধান কাঁচামাল হলো মাটি এবং ইটভাটাগুলো কৃষিজমির পাশে অবস্থান নিয়ে কৃষিজমির উর্বর মাটি ব্যবহার করে, যা আমাদের পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি প্রধান হুমকি।

কৃষিজমির উপরিভাগের বা টপসয়েলের ৬ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি সরানো হলে তা মাটির উর্বরাশক্তি কমিয়ে দেয়; অথচ ক্ষেত্রবিশেষে ইটভাটাগুলো ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি সরিয়ে নিচ্ছে। এই ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করতে না পারলে বায়ুদূষণ থেকে আমাদের শিগগিরই কোনো পরিত্রাণ হবে না।
বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের এক গবেষণা বলেছে, একসময় বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের বিস্তার ছিল ১৭ হাজার বর্গকিমি, যা এখন ৬ হাজার ৪৬৭ বর্গকিমি। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বলা হয়েছে, সারা দেশে প্রায় ২৫৭ হাজার একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে। প্রায় ১৬১ হাজার প্রভাবশালী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এসব বনভূমি জবরদখল করে রেখেছে।

বনের জমি দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে তৈরি করা হয়েছে শিল্পকারখানা। বাংলাদেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের আয়তনের প্রায় ১১ শতাংশ।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে আশাব্যঞ্জক তথ্যও রয়েছে। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দেশের মোট আয়তনের ২২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়ে ইতোমধ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার সুন্দরবন সংরক্ষণে নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে, যার ফলে সুন্দরবনের বৃক্ষ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় বন জরিপের তথ্যমতে, সুন্দরবনে মোট কার্বন মজুতের পরিমাণ ১৩৯ মিলিয়ন টন, যেখানে ২০০৯ সালে পরিচালিত জরিপ অনুসারে এর পরিমাণ ছিল ১০৭ মিলিয়ন টন। অপরদিকে, ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে পানিতে পরিণত হচ্ছে, অবমুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন অণুজীব। যথেচ্ছ নদীদূষণের পাশাপাশি সমুদ্রে-নদীতে-জলাশয়ে মাছের সংখ্যা দিনদিন কমছে, বাড়ছে প্লাস্টিক বোতলের সংখ্যা। ঢাকার চারপাশের সব নদীর পানি বহু আগেই তার স্বাভাবিক গুণাগুণ হারিয়েছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, টেকনাফ সৈকতসহ দেশের ছয়টি এলাকাকে সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছে। সেন্টমার্টিন সৈকতের প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চোখে পড়ে কাচের বোতল, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট, আচারের প্যাকেট, পলিথিন, ক্যান, চায়ের কাপ, স্ট্র, বিস্কুটের প্যাকেট, মাছ ধরার জালের টুকরা, নাইলনের দড়িসহ বিভিন্ন অপচনশীল বর্জ্য।

ঢাকা শহরেই প্রতিদিন ১২৪ টন প্লাস্টিকজাতীয় বর্জ্য তৈরি হয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের নগর অঞ্চলগুলোয় বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২০০৫ সালে ৩ কেজি ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে তা ৩ গুণ বেড়ে ৯ কেজি হয়েছে। এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালের এক প্রতিবেদন বলছে, মানুষের শরীরে মাইক্রো-প্লাস্টিক বাতাসের পাশাপাশি খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমেও ঢুকতে পারে। উপরন্তু, খাদ্যের সাধারণ স্বাদ, পুষ্টি ও গুণাগুণের মধ্যে ভেজালমিশ্রণ ও অনন্যোপায় হয়ে তা গ্রহণ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক গ্রাউন্ডসওয়েল প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীব্যাপী পরিবেশের বিপর্যয় শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে ২০৫০ সাল নাগাদ। এ সময় দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে অভিবাসিত হবে প্রায় ৪ কোটি মানুষ এবং যার অর্ধেকই হবে বাংলাদেশের। অপরিকল্পিত কৃষিব্যবস্থা, শিল্পায়নে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বনভূমি, পাহাড়, নদী সংরক্ষণ ও নগরায়ণের পরিবেশগত বিষয়গুলোকে অগ্রাহ্য করা এবং দেশে বিদ্যমান অপ্রতুল পরিবেশগত আইনের প্রয়োগ আজ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে এখন বহুমাত্রিকতায় দৃশ্যমান হচ্ছে।

বারবার বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্যক বিপদ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা সতর্কসংকেত দিলেও ধনী দেশগুলোর বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তা কাজে আসছে না।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত অবক্ষয়ের অভিশাপ থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে হলে উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর পরিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি জীবাশ্মজ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নমনীয় হতে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাস্তুসংস্থান ও খাদ্যচক্র সংরক্ষণ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনপ্রণালিতে পরিবর্তন ও কৃষিব্যবস্থাকে পরিবেশবান্ধব করে মানুষের মানবিক-নৈতিক-পরিবেশগত মূল্যবোধ সুরক্ষায় সচেষ্ট হওয়া আজ সময়ের দাবি।

সাভারের চামড়াশিল্পের বর্জ্য থেকে নদীদূষণের ভয়াবহ চিত্র দেখে গভীর হতাশা ব্যক্ত করেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী। অন্যদিকে সাত বছর আগে নারায়ণগঞ্জে শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য পরিশোধনে যে দুটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। এটা দুর্ভাগ্যজনক।
উল্লেখ্য, সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদিত হয়, অথচ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা রয়েছে ২৫ হাজার ঘনমিটারের। এর অর্থ দৈনিক ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য সরাসরি গিয়ে নদীতে পড়ছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান গত সোমবার সাভারের হেমায়েতপুরে বিসিক চামড়াশিল্প নগর পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সাভার অভিশপ্ত জনপদে পরিণত হতে যাচ্ছে। ‘চামড়াশিল্প নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক কার্যক্রম নিয়ে আমরা হতাশ।
ল্যাবে এসে দেখি, ল্যাবের ইনচার্জ অনুপস্থিত। তাঁর অবর্তমানে কোনো লোক নেই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই।’ সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরের বর্জ্যে ধলেশ্বরী নদীর পানিসহ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ধলেশ্বরীর সঙ্গে বংশী, বুড়িগঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি নদীর সংযোগ রয়েছে। এ কারণে ওই সব নদীও মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটি সাভারের শিল্পনগরীর বর্জ্যে নদী ও আশপাশের এলাকা দূষণে উদ্বেগ প্রকাশ করে এটি বন্ধ করার সুপারিশ করেছিল। কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর মন্তব্য ছিল, ‘চামড়াশিল্প যেভাবে আছে, তা চলতে দেওয়া যাবে না। আমাদের উদ্বেগের বিষয় সলিড ওয়েস্ট।
সেখানে এটা ট্রিটমেন্টের কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেই।’ নদী কমিশনের চেয়ারম্যান চামড়াশিল্প বন্ধ করার কথা না বললেও নদীদূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। সে ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও নদী কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্যে খুব ফারাক নেই। তাঁদের দুজনের কথার মর্মার্থ হলো শিল্প বা উন্নয়নের জন্য নদী ও পরিবেশের ক্ষতি করা যাবে না।
প্রশ্ন হলো বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? সংসদীয় কমিটি কিংবা নদী কমিশন নদী রক্ষায় সুপারিশ করতে পারে মাত্র। এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে বর্জ্য শোধনের সমস্যাটি শুরু থেকেই ছিল। সেখানে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার তৈরি করে দেওয়ার কথা ছিল বিসিকের। তারা যে চীনা কোম্পানিকে এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছিল, তারা সেটা করতে পারেনি। এই ব্যর্থতার জবাব কী।
নারায়ণগঞ্জের ডাইং ও ওয়াশিং শিল্পকারখানার নির্গত তরল বর্জ্য থেকে শীতলক্ষ্যাকে রক্ষা করতে পরিবেশ অধিদপ্তর দুটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের প্রস্তাব দেয় ২০১৫ সালে। ইতিমধ্যে সাত বছর পার হয়েছে। নদীদূষণ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। অথচ কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে সংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানার বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করেই দায়িত্ব শেষ করছে।
বুড়িগঙ্গা রক্ষার কথা বলে ধলেশ্বরীর পাড়ে চামড়াশিল্প স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা দুটিই দূষিত হচ্ছে। চামড়াশিল্প নগরীতে তৈরি পুরো বর্জ্যই শোধন করতে হবে; যাতে নদী দূষিত না হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে শিল্পকারখানার প্রয়োজন আছে, স্বীকার করি। কিন্তু তা করতে হবে আইন মেনে, নদী ও পরিবেশকে ধ্বংস করে নয়।


বিআইপির গবেষণায় জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান ধ্বংসের কারণ বিশ্লেষণের জন্য পরিবেশগত বিপর্যয়ের ১০০টি কেস স্টাডি সমীক্ষা করা হয়েছে, যার মধ্যে পানিদূষণ (৪২), বায়ুদূষণ (২৯), মাটিদূষণ, বৃক্ষনিধন (১৭), প্লাস্টিক দূষণ (৮) ও অন্যান্য দূষণ (৮) নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়।
পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঘটনাগুলো পর্যালোচনার মাধ্যমে বিআইপির সমীক্ষায় পরিলক্ষিত হয় যে, পরিবেশ ও প্রতিবেশ দূষণের শতকরা ৭০ ভাগ ঘটনার ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায় আছে, শতকরা ৫০ ভাগ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের দায় পরিলক্ষিত হয়।

অনুরূপভাবে এ ধরনের পরিবেশ দূষণের ঘটনা বিশ্লেষণে নগর কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে ৫০ শতাংশ, শিল্প-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ৫০ শতাংশ, বন বিভাগ ৩০ শতাংশ, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ৬০ শতাংশ ও জনগণের উদাসীনতার ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দায় রয়েছে।
বিআইপির সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, পরিবেশের প্রতি আমাদের সংবেদনশীল হতে হবে এবং পরিবেশের প্রতি যত্নশীল থেকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। উন্নয়নসংক্রান্ত সব নীতিমালায় পরিবেশের বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে এবং পরিবেশ নিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।

ক্রাইম ডায়রি/ পরিবেশ