দুদক কি সফল না ব্যর্থ? দুদকের সেকাল একাল

দুদক কি সফল না ব্যর্থ? দুদকের সেকাল একাল

আতিকুল্লাহ আরেফিন রাসেলঃ   

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গোড়ার দিকে নাম সর্বস্ব হলেও বিগত কয়েক বছরে অপরাধীদের আতংকের নাম ছিল দুদক। অনেক সরকারী প্রতিষ্ঠানে ঘুষ প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে হঠাৎ করেই ঝাঁকি দিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে একশন নেয়ায় অপরাধ প্রবনতা কমেও এসেছিল। তবে,  কতটা স্বাধীন কিংবা এই প্রতিষ্ঠানটি দেশে বিদ্যমান দুর্নীতি দমনে কতটা সফল- এমন প্রশ্ন এখন অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ক্লিন ইমেজের ব্যাক্তিত্ব ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের মেয়াদকালে গত সাড়ে চার বছরে দুর্নীতি নির্মূলে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছেন, তিনি কোন ধরনের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন এবং কোথায় ব্যর্থ ও কেন ব্যর্থতা  টিআইবির পক্ষ থেকেও এ ধরনের প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছে। কারন ছয় মাস পরই শেষ হচ্ছে দুদক চেয়ারম্যানের পাঁচ বছর চুক্তির মেয়াদ।

কথাটা কিন্তু  মানতেই হবে যে, একটি নাম শুনলে দুর্নীতিবাজের বুকে একটু হলেও ঝাঁকুনি দেয়। এমন অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে, যারা ভেবেছিলেন কিছুই হবে না। অনেকের হাতে হাতকড়া পড়েছে। এর নাম দুদক।।। সফলতা কিংবা ব্যর্থতা প্রাতিষ্ঠানিক এমন হিসাবের বাইরে সাধারন জনগন উপকৃত হয়েছেন এমন হিসাবের দিকেই নজর সবার। 

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সাংবাদিকদের  বলেন, মানুষের প্রত্যাশা পূরণে দুদকের ঘাটতি রয়েছে। ছোট ও মধ্য পর্যায়ের লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও উচ্চপর্যায়ের লোকজনের বিরুদ্ধে দুদক উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এ কারণে দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে। প্রকারান্তরে উচ্চপর্যায়ের লোকজনকে সুরক্ষা দিয়েছে।

একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট ও দুদক সুত্রে জানা গেছে,  সংস্থাটি  দেশের মানুষের কাছ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ গ্রহণের জন্য একটি বিশেষ হটলাইন (১০৬) চালু করে। হটলাইনে ২০১৯ সালেই ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫২৪টি ফোন কল পায় দুদক। এর মাধ্যমে ১ হাজারের বেশি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এজন্য দুদক একটি এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গঠন করেছে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বিএফআইইউ’র সঙ্গে তথ্য আদানপ্রদানে চুক্তি করে সংস্থাটি। নতুন অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী মহাপরিচালক থেকে উপসহকারী পরিচালক পর্যন্ত অনুসন্ধান ও তদন্তে যুক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়। দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ উদ্ধারে চেষ্টা ছিল পুরো সময়জুড়ে। এক ডজন এমপির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে মামলাও করেছে তারা। বড় বিষয় ছিল এসব কাজ বাস্তবায়নে কমিশনারদের মাঝে বড় ধরনের কোনো মতবিরোধ ছিল না। ইকবাল মাহমুদ ছাড়াও কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান ও এএফএম আমিনুল ইসলাম দুদকের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে বিশেষ নজর দেন। তারা মনে করেন, একটি প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হলে তার কার্যক্রমও শক্ত হয়। কমিশন সে কাজটিই করেছে।

এসব সফলতার পাশাপাশি দুদকের ব্যর্থতার দিকও রয়েছে বলে অনেকে বলে থাকেন। অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে বেসিক ব্যাংকের তদন্ত শেষ করতে না পারা, পানামা ও প্যারাডাইস কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে না পারা, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম, কানাডার বেগমপাড়া, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়াসহ পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে খুব বেশি সফলতা দেখাতে পারেনি দুদক। তবে বিগত সময়ে অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও দুদক ঘুরে দাঁড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই । অনেক প্রভাবশালীর অনুরোধ উপেক্ষা করে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ অব্যাহত রেখেছে। বেশ কয়েকজন এমপিকে দুদকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। বেশ কয়েকজন আমলা, তিনজন ডিআইজিসহ উচ্চপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা, প্রভাবশালী রাজনীতিকও দুদকের জালে আটকা পড়েছেন।

বেসরকারি পর্যায়ের কোনো প্রভাবশালীর অর্থ পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদককে অনেক হিসাব করে হাত দিতে হয়। কারণ দুদক আইনে কেবল সরকারি পদে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ বিদেশে অর্থ পাচার করলে তাকেই আটঘাট বেঁধে ধরা যায়। ২০১৫ সালে মানি লন্ডারিং আইন সংশোধন করে দেশের বাইরে অর্থ পাচারের তদন্তভার বিএফআইইউসহ অন্য কয়েকটি সংস্থাকে দেয়া হয়। বাদ পড়ে দুদক। এই আইনি সীমাবদ্ধতার মাঝেও বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের অর্থ পাচারের তদন্তে দুদককে একটি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে দেখা গেছে। তা হল- যারা বিদেশে অর্থ পাচারে জড়িত, তাদের অবৈধ সম্পদ নিয়ে টান দেয়া। দুদক মনে করে, বৈধ কোনো অর্থ অবৈধভাবে দেশের বাইরে পাচার হয় না। ফলে এক্ষেত্রে কয়েকটি ঘটনায় দুদক বেশ সফলতাও পায়। স্বাস্থ্যের কর্মচারী আফজাল হাজার কোটি টাকার মালিক। দুদকের রিমান্ডে স্বীকার করেছেন দেশের বাইরে কী পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। আফজালের মতো আরও হাজারও আফজাল আছে বিভিন্ন খাতে।।। ঘাপটি মেরে থাকা অনেকে আবার সেক্টর পরিবর্তন করে সাধু সাজবার চেষ্টাও করে যাচ্ছেন।  ব্যবসায় লগ্নি করে হারাবার চেষ্টা করছেন নিজ সাবেক পরিচয়।     এমন আরও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার বিদেশে কিংবা দেশে অর্থ পাচার কিংবা এহেন বিষয়ে তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে এবং তা নিয়ে কাজ চলছে । দুদকের তদন্তের মুখে পড়ে আর্থিক খাতের অর্থ লোপাটকারী প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) দেশে ফিরে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে নেয়া অর্থ উদ্ধারে সাহায়তা করতে চায়। দুদক জানায়, মামলার তদন্ত ও প্রাথমিক অনুসন্ধান চলাকালে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ উদ্ধার হয়েছে। ২০১৯ সালেই ৪৩৬ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করেছে। দুদকের মামলায় ৩ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা জরিমানাও হয়েছে। সাজার পরিমাণও আশিভাগ। সরকারী বিভিন্ন সংস্থা হতে চাকরী করে কোটি টাকার দূর্নীতি করে চাকরী ছেড়ে বিভিন্ন বেসরকারী ব্যবসা কিংবা চাকরীতে সেটেল্ড হবার ধান্দাও করেন অনেক এমন অপরাধীদের বিষয়ে তালিকা তৈরি হচ্ছে দুদকে বলে জানা যায়।।      

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু মামলা দায়ের নয়, আসামিদের গ্রেফতার, দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ মামলায় সংশ্লিষ্ট অবৈধ সম্পদ জব্দ করার ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে কমিশন। ইকবাল মাহমুদ যোগদানের প্রথম বছরেই বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় প্রায় ৪০০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমান কমিশনের সময়ে অন্তত এক হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে দুদক। পিকে হালদারসহ পাঁচ শতাধিক আলোচিত ব্যক্তির সম্পদ জব্দ করে দুদক। আবার এমন অভিযোগও করেন অনেকে যে ভিলেজ পলিটিক্স কিংবা আক্রোশপ্রসূত কারনেও ভুল তথ্য কিংবা নগন্য পাপে গুরুদন্ডের শিকারও হয়েছেন অনেকে। অনেক ক্ষেত্রে অবহেলাজনিত কিংবা অর্থনৈতিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়। তবুও বিশ্লেষকরা মনে করছেন দুদকের ইকবাল মাহমদ কালটা দুদকের স্বর্নযুগ। দুদক ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং অপরাধের মূলে আঘাত এনেছে তার নেতৃত্বে। এমনধারা অব্যহত থাকুক এমনটাই কামনা জনগনের।

ক্রাইম ডায়রি/// জাতীয়