বিশাল সংকোচনের ফাঁদে জাপানের অর্থনীতি

এক দুই তিন ডেস্কঃ

বিশাল সংকোচনের ফাঁদে জাপানের অর্থনীতি
বিশাল সংকোচনের ফাঁদে জাপানের অর্থনীতি

চলতি বছরের শুরুর দিকে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের তাণ্ডব শুরু হওয়ার আগে থেকেই জাপানের অর্থনীতি খুব বেশি ভালো অবস্থায় ছিল না। বিশেষ করে গত বছর অক্টোবর মাসে জাপান সরকার ভোগ্যপণ্য কর ৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে বৃদ্ধি করলে নাগরিকদের অনেকেই কেনাকাটা নিয়ে সতর্ক হয়ে ওঠেন। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাস পেলে অর্থনীতি সংকোচনের পথে এগিয়ে যায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সংগতি রেখে মানুষের উপার্জন বৃদ্ধি না পাওয়া হচ্ছে এর কারণ।

সরকারের উপদেষ্টারা অবশ্য আগে থেকেই এ রকম পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার আভাস দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তাঁরা অবশ্য আরও ধারণা করেছিলেন যে অর্থনীতির ওপর ভোগ্যপণ্য কর বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া হবে সাময়িক এবং জাপানের অর্থনীতি অচিরেই আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। তবে আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকা করোনাভাইরাস সেই হিসাবকে কেবল ভুল প্রমাণিত করেনি, একই সঙ্গে অর্থনীতিকে গভীর সংকটের দিকে সেটা টেনে নিয়ে গেছে। সংকট কতটা গভীর হয়ে দানা বাঁধছে, তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় জাপান সরকারের কেবিনেট দপ্তরের আজ সোমবার প্রকাশিত কিছু উপাত্তে।

 

কেবিনেট দপ্তর চলতি বছরের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিক সময়ের জন্য প্রবৃদ্ধির যে প্রাথমিক হিসাব প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, এই সময়ে জাপানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। বার্ষিক হিসাবে এই সংকোচনের হার হচ্ছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে জাপানের অর্থনীতি যুদ্ধের ঠিক পরের বিশৃঙ্খল দিনগুলো ছাড়া আর কখনোই এত বেশি সংকুচিত হয়নি। বার্ষিক হিসাবে এর আগের সবচেয়ে বড় ত্রৈমাসিক সংকোচন ছিল ২০০৯ সালে জানুয়ারি–মার্চ সময়ে, বিশ্বজুড়ে চলা আর্থিক সংকটের মুখে অর্থনীতি যখন আগের ত্রৈমাসিকের চেয়ে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ হারে সংকুচিত হয়েছিল। এর ফলাফল অবশ্য সরকারের জন্য মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। সেই একই বছর গ্রীষ্মকালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতাসীন উদার গণতন্ত্রী দল এলডিপিকে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে নিতে হয়েছিল। এবার অবশ্য সে রকম কিছু আশা করা হচ্ছে না, যদিও ক্ষমতাসীন দলের জন্য স্বস্তিতে থাকার ইঙ্গিত এটা দিচ্ছে না।

 

ভোগ্যপণ্যের কর বৃদ্ধির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলতে থাকা বাণিজ্য সংঘাতও জাপানের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে অর্থনীতির ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়া থেকে। ভাইরাস মোকাবিলায় জাপান সরকার এপ্রিল মাসে প্রথমে টোকিও ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলায় এবং পরে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়ে। পাশাপাশি জাপানের বিভিন্ন স্থানীয় সরকার ভাইরাসের বিস্তার বন্ধ করতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার আহ্বান জানালে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে।

সরকার অবশ্য দেশের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সেগুলো কোনো অবস্থাতেই ছিল না। ফলে করোনাভাইরাসের বিস্তার অব্যাহত থাকলেও সরকার অর্থনীতিকে অচল করে দিতে পারে, এমন পদক্ষেপ নিতে চাইছে না। বরং নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে ভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাবকে কীভাবে সীমিত পর্যায়ে ঠেকিয়ে রাখা যায়, সেই পথ ধরেই অগ্রসর হচ্ছে জাপান সরকার। ফলে আবারও ধীরে হলেও সচল হয়ে উঠছে জাপানের অর্থনীতি। তবে এই পথে পুনরুদ্ধার আসবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতান্তর রয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে অর্থনীতি পূর্ববর্তী ত্রৈমাসিকের চেয়ে বার্ষিক হিসাবে ১০ শতাংশের বেশি সম্প্রসারিত হবে। তবে এর অর্থ এই নয় যে অর্থনীতি আবারও দ্রুত করোনা–পূর্ববর্তী সময়ের পর্যায়ে ফিরে যাবে। অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, জাপানের অর্থনীতির সে রকম অবস্থায় ফিরে যেতে অন্তত কয়েক বছর লেগে যাবে। ফলে এই অন্তর্বর্তী সময়ে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কঠোর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষপাতী তাঁরা নন।

জাপানের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনমন্ত্রী ইয়াসুতোশি নিশিমুরা গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে সরকার অর্থনীতিকে এপ্রিল ও মে মাসের তলানি অবস্থা থেকে তুলে আনবে। এই লক্ষ্যে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের শিথিল মনোভাব এখন আরও বেশি করে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও সতর্কতা বজায় রাখার বাইরে নাগরিকদের জন্য করণীয় নতুন উপদেশ সরকার এখন আর দিচ্ছে না।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চললেও মৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়া সরকারের এই উদ্যোগের পেছনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। মানুষ এখন আর করোনাভাইরাস নিয়ে প্রাথমিক অবস্থার মতো ততটা আতঙ্কিত নন। এর মধ্যে ভাইরাসের টিকা এসে গেলে পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং জাপানের অর্থনীতির ধীর অগ্রযাত্রা তখন হয়তো আরও বেশি পরিষ্কার হয়ে উঠবে। তবে আপাতত তলানি থেকে উঠে আসা হচ্ছে অর্থনীতির সামনে দেখা দেওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।