বাসাবাড়ির গ্যাস সংযোগে প্রিপেইড মিটারঃ দাম বাড়লেও খরচ কমবে

বাংলাদেশে রান্নার গ্যাস ব্যবহারে চুলা প্রতি টাকা দেয়ার বদলে প্রিপেইড মিটারে খরচ ও গ্যাসের ব্যবহার দুটোই অনেক কম হয়। কিন্তু আপাতত মিটার বসানোর প্রকল্প বন্ধ রয়েছে। অর্থায়নের অভাবে মিটার দেয়া হচ্ছে না এবং নতুন আবেদনও নেয়া হচ্ছে না, বলছে কর্তৃপক্ষ।

বাসাবাড়ির গ্যাস সংযোগে প্রিপেইড মিটারঃ দাম বাড়লেও  খরচ কমবে
অর্থায়নের অভাবে মিটার দেয়া হচ্ছে না এবং নতুন আবেদনও নেয়া হচ্ছে না, বলছে কর্তৃপক্ষ। উল্টো চুলা প্রতি খরচ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অথচ ঢাকার সব এলাকায় ঠিকমতো গ্যাসও পাওয়া যায় না। দুপুরের দিকে নিভুনিভু হয়ে যায় আগুন। কিন্তু মাসের বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে।
প্রকৌশলী আয়াতুস সাইফ মুনঃ

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে হুহু করে। আইওয়াশের জন্য মজুতদাররা একদিকে দাম কমালেও নানান অজুহাতে অন্যদিকে দাম বাড়িয়ে দেয়। নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধিতে এমনিতেই হিমশিম অবস্থা জনগনের। এরই মধ্যে বাসাবাড়ির গ্যাসের দাম ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বিইআরসি। এতে করে দুই চুলার গ্রাহকদের মাসে ১০৫ টাকা এবং এক চুলার গ্রাহকদের মাসে ৬৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে একটি চুলার জন্য খরচ ৯২৫ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৯৯০ টাকা এবং দুই চুলার ক্ষেত্রে ৯৭৫ থেকে ১০৮০ টাকা।

বাংলাদেশে রান্নার গ্যাস ব্যবহারে চুলা প্রতি টাকা দেয়ার বদলে প্রিপেইড মিটারে খরচ ও গ্যাসের ব্যবহার দুটোই অনেক কম হয়। কিন্তু আপাতত মিটার বসানোর প্রকল্প বন্ধ রয়েছে। অর্থায়নের অভাবে মিটার দেয়া হচ্ছে না এবং নতুন আবেদনও নেয়া হচ্ছে না, বলছে কর্তৃপক্ষ। উল্টো চুলা প্রতি খরচ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অথচ ঢাকার সব এলাকায় ঠিকমতো গ্যাসও পাওয়া যায় না। দুপুরের দিকে নিভুনিভু হয়ে যায় আগুন। কিন্তু মাসের বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে।

প্রিপেইড মিটারে যে সুবিধাঃ
যে সুপারিশ বিইআরসি থেকে করা হয়েছে তাতে গ্যাসের চুলা ব্যবহারকারীদের জন্য খরচ আবারো বাড়তে যাচ্ছে। প্রিপেইড মিটারে খরচ কতটা কম তার ধারণা পাওয়া গেল কয়েকজন ভোক্তার সাথে কথা বলে। ঢাকার বাসিন্দা নূপুর ইসলামের বাড়িতে পাঁচটি ফ্ল্যাটে মাস পাঁচেক আগে প্রিপেইড মিটার বসানো হয়েছে। তিনি বলছেন, এর আগে দুই চুলায় তার মাসে খরচ হতো ৯৭৫ টাকা। কিন্তু মিটার বসানোর পর সেই খরচ কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ শ’ টাকায়।

খরচের ধারণা দিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘আমরা গত মাসে মিটারে পাঁচ শ’ টাকা রিচার্জ করেছিলাম। এতে আমার প্রায় পুরো মাস বা ২৫ দিনের মতো চলে গেছে। পাঁচ শ’ টাকার মধ্যেই মিটারের ভাড়া এবং ভ্যাটও আছে। প্রিপেইড মিটার লাগানোর পর গ্যাসের জন্য প্রতি মাসে মোটামুটি এরকমই খরচ হয়।’ তবে এটা অনেকটাই নির্ভর করে ব্যবহারকারীর উপর, বলছিলেন নাসরিন আক্তার নামে ঢাকার আর এক বাসিন্দা। তারা একটি ভবনের নয় ফ্ল্যাটের বাসিন্দা একসাথে প্রিপেইড মিটার বসিয়েছেন।

তিনি বলছেন, ‘আগে যেমন করতাম এখন আর তেমন করি না। যেমন আগে একটা রান্না সারলাম, চুলা জ্বালানো থাকতো, হয়ত কিছু একটা আনতে গেলাম বা রান্নাঘরে অন্য কিছু করলাম। অথবা প্রায়ই দেখা যেত চুলা হালকা করে জ্বালিয়ে রেখেও অনেক কিছু করতাম। এখন আর সেটাতো করিই না বরং সবকিছু রেডি করে একবারে চুলা ধরাই, সব রান্না একসাথে করে বের হই। গ্যাসের বিল কত হবে এটা আসলে পুরোটাই আমার উপর নির্ভর করে।’

তিনি বলছেন, মিটারের জন্য মাসের ৬০ টাকা ভাড়া ও ভ্যাটসহ তার খরচ হয় ৬০০ টাকার মতো। রিচার্জ করা টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই তিতাস গ্যাসের বুথে গিয়ে আবার টাকা ভরে নেন তিনি। চুলা জ্বলতে থাকলে মিটারে পয়সা বাড়বে এই ধারণাটির কারণেই তিনি গ্যাস ব্যাবহারে সাশ্রয়ী হয়েছেন। তার ভবনে নয়টি মিটার বসাতে খরচ হয়েছে ১৪ হাজার টাকা।

বিভিন্ন এলাকায় তিতাস গ্যাসের স্থানীয় কর্মীরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে এক সময় প্রিপেইড মিটার বসানোর তাগাদা দিয়েছেন। কাগজপত্র পূরণ, মিটারের দাম ও বসানোর খরচ নিয়ে সব কাজগুলো তারা নিজেরাই করে দিয়েছেন। মিটারের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেয়া হয় না। মিটারটি স্থাপনে যদি ভবনের গ্যাস সঞ্চালনে কোন ধরনের পরিবর্তন আনতে হয় সেটির খরচ দেন গ্রাহক। শুরুতে অনেকেই আগ্রহী হননি। কিন্তু এখন এসব সুবিধার কারণে ঢাকার আরো অনেক বাসিন্দা গ্যাসের প্রিপেইড মিটারে আগ্রহী। সেটা দেয়া হচ্ছে না, উল্টো চুলা প্রতি খরচ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

যেমন ঢাকায় সম্প্রতি বাসা বদল করা এক বাসিন্দা সালেহা বেগম বলছিলেন, ‘আমি লালমাটিয়া থেকে বাসা বদল করে ঢাকার শ্যামলী এসেছি। আগের বাসায় প্রিপেইড মিটার ব্যাবহার করেছি আমি। নতুন এলাকায় এসে দেখি সেটা নেই। আগে যেখানে মাসে পাঁচ থেকে ছয় শ’ টাকা রিচার্জ করলে হয়ে যেত, এখন চুলার জন্য মাসে তিন শ’ বা সাড়ে তিন শ’ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। আমি যেহেতু প্রিপেইড মিটারের সুবিধাটা বুঝতে পেরেছি, এখন আমি নতুন এলাকাতেও সেটা চাই কিন্তু আমি তা পাচ্ছি না। কারণ এটা এখন দেয়া হচ্ছে না।’

চুলার ক্ষেত্রে টাকা ফুরিয়ে গেলেই প্রিপেইড মিটারের মতো গ্যাস সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি না থাকলেও ভোক্তার খরচ বেশি। অন্যদিকে গ্যাসের অপচয়ও বেশি। গত বছর দেয়া বিইআরসি'র হিসাবে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার গ্যাস চুরি হচ্ছে। মিটার বসানো হলে এই চুরি ঠেকানো সহজ হয়।

২০১১ সালে শুরু হওয়ার পর এক দশক পার হয়ে গেছে, অর্থায়নে আগ্রহী রয়েছে বেশ কটি সংস্থা, সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটার দিতে বিইআরসি থেকে পরিপত্র জারি হয়েছে এবং বারবার তাগাদাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও মিটার বসাতে এত দেরি কেন লাগছে কেন সেনিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর জন্য মিটারের চাইতে চুলা প্রতি অর্থ পরিশোধ বেশি লাভজনক। কোম্পানিগুলোর তরফ থেকে প্রিপেইড মিটার কার্যক্রমে ঢিলেমির এটিও একটি কারণ বলে মনে করছেন তিনি।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ২০২০-২১ সালের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে আবাসিক পর্যায়ে গ্রাহক রয়েছে সাড়ে আঠার লাখের মতো। ২০১১ সালে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে প্রিপেইড মিটার বসানোর কাজ শুরু করে রাষ্ট্রীয় কোম্পানিটি। সেসময় অল্পকিছু মিটার বসানো হয়েছিল। ২০১৭ সালে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি'র অর্থায়নে প্রিপেইড মিটার বসানোর কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালে বিইআরসি সকল গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটার বসানোর নির্দেশনা দেয়। কিন্তু এখন চলমান কোনো প্রকল্প নেই তাই বন্ধ রয়েছে মিটার বসানো। ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বিবিসিকে বলেছেন, তারা মিটার বসানোর ক্ষেত্রে গড়িমসি দেখতে পাচ্ছেন।

‘তাদের দিক থেকে তারা বলে যে প্রিপেইড মিটারে বিনিয়োগ করার মত পর্যাপ্ত অর্থ নেই, বসানোর জন্য জনবলের সঙ্কট। এই কারণে তাদের ধীরগতি হচ্ছে। কিন্তু এধরনের ব্যাখ্যা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলো নিজেরাই প্রিপেইড মিটার কিনে লাগিয়ে দেবে পলিসিতে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভোক্তা নিজে মার্কেট থেকে কিনতে পারবে না। বিতরণ কোম্পানিগুলো মিটারের ব্যবসায় থাকতে চায়। কিন্তু আবার মিটার যেহেতু গ্যাস চুরি ঠেকায় সেজন্য এখন তারা নিরুৎসাহিত।’

কতদূর এগুলো মিটার বসানোর কাজ
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনের কোম্পানির প্রিপেইড মিটার প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ সালেহ জানিয়েছেন, জাইকার দেয়া অর্থে একটি প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত তিন লাখ ২০ হাজার মিটার বসানো হয়েছে। সামনে এক লাখ মিটার বসানোর জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

‘আমরা সার্ভে করে দেখেছি। মিটার লাগানোর পর প্রথম দুই মাস আমরা পোস্ট পেইড মোডে রেখেছি। তখনকার গ্যাস ব্যবহার এবং মিটার চালু হওয়ার পর গ্যাস ব্যবহারে অনেক পার্থক্য। গ্রাহক নিজেই তাদের ব্যবহার অনেক কমিয়ে আনে। তারা ইচ্ছে মতো গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখে না। গ্যাস অন্তত সাশ্রয় হচ্ছে, বিবিসিকে বলেন তিনি।

তিনি বলছেন, প্রায় শ’ই গ্রাহকরা আমাদের কাছে আসছেন। কিন্তু আমরা আপাতত আবেদন অফিসিয়ালি আর নিচ্ছি না। কারণ নতুন প্রকল্প কবে চালু হবে সেটা এখনো ঠিক হয়নি।’ মিটার বসানোর ব্যাপারে কোনো ধরনের গড়িমসির বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে কোনো রিলাকট্যান্স (অনীহা) নেই বরং আমরা আরো মিটার বসানোর জন্য প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছি। আরো ৮০ হাজার মিটার বসবে জাইকার প্রকল্পের বাকি টাকা পেলে।’

 

ক্রাইম ডায়রি// অর্থ/-বানিজ্য/ সুত্র : বিবিসি