স্বপ্নের পদ্মাসেতুঃ বদলে যাচ্ছে পদ্মাপারের অর্থনীতি

কৃষি ও শিল্প পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা দ্রুত হবে। বাড়বে অর্থের প্রবাহ ও হাতবদল। সবমিলিয়ে এ সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে পড়বে ইতিবাচক প্রভাব।

স্বপ্নের পদ্মাসেতুঃ বদলে যাচ্ছে পদ্মাপারের অর্থনীতি
ছবি- অনলাইন হতে সংগৃহীত

পদ্মা সেতুর কারণে খুলনার মোংলা ও পটুয়াখালীর পায়রা, যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার ভোমরাবন্দরের কার্যক্রমে অনেক বেশি গতি পাবে

শরীফা আক্তার স্বর্নাঃ

বহু ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত পদ্মাসেতু। দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ দেশের টাকায় নির্মিত এই সেতু দেশ ও জাতির সক্ষমতার প্রতীক। অমানবিক কষ্ট এবং ত্যাগের সার্থকতা পেয়েছে পদ্মাপারের জনগন।

 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হলে পরিবর্তন হয়ে যাবে  নদীর দুই পারের অর্থনীতি। সেতুর কারণে দুই পারের জেলাগুলোর মধ্যে সরাসরি গণপরিবহণ চলাচল করবে। এতে মানুষের যোগাযোগ সহজ ও দ্রুত হবে, বাড়বে যাতায়াত। নদীর ওপারে ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প পর্যটন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বিকাশ ঘটবে।

 কৃষি ও শিল্প পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা দ্রুত হবে। বাড়বে অর্থের প্রবাহ ও হাতবদল। সবমিলিয়ে এ সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে পড়বে ইতিবাচক প্রভাব।

 একটি আন্তর্জাতিক  সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু চালু হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারের ফলে জিডিপি ১ দশমকি ২ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে। এর প্রভাবে অর্থনীতির আকার বাড়বে, দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিনিয়োগ হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে এবং দারিদ্র্য কমবে।

শিল্পের বিকাশ হবে। গড়ে উঠবে বিভিন্ন রিসোর্ট, হোটেল, মোটেল ও বিনোদন পার্ক। এছাড়া নদীকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। পদ্মার ওপারে জমির দাম ও শ্রমের মূল্য এ পারের তুলনায় কম হওয়ার কারণে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। ফলে শিল্প গড়ে উঠবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। দারিদ্র্য কমবে।

পদ্মা বহুমুখী সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে বিভিন্ন সংস্থার পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকে উল্লিখিত সব তথ্য পাওয়া গেছে। সেতু বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদ্মা সেতুর বহুমুখী কার্যক্রম নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। ওইসব প্রতিবেদনে পদ্মা সেতুর সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরা হয়।

সেতু নির্মাণে মোট খরচ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু শুধু এ অর্থ নিয়ে পদ্মা সেতুকে মূল্যায়ন ঠিক হবে না। এর প্রভাবে দুই পারের মানুষের জীবনযাত্রার যে পরিবর্তন আসবে তা অর্থ দিয়ে মূল্যায়ন করা যাবে না। আর্থিক হিসাবে জিডিপিতে যোগ হবে বাড়তি  ৪৮ হাজার থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা প্রায়।

দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলায় বদলে যাবে অর্থনৈতিক চিত্র। খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১৫ জেলা। এছাড়া ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ জেলায়ও এর প্রভাব পড়বে। সারা দেশের সঙ্গে এসব জেলার সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। বর্তমানে সন্ধ্যার পর মাওয়া ঘাট থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। ফলে এ ঘাট দিয়ে ওপারে যাতায়াতও বন্ধ থাকে। পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে সব সময় ফেরি চললেও যানজট লেগেই থাকে।

পদ্মা সেতুর কারণে খুলনার মোংলা ও পটুয়াখালীর পায়রা, যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার ভোমরাবন্দরের কার্যক্রমে অনেক বেশি গতি পাবে।

পায়রা বন্দরকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে রিজার্ভ থেকে ৫২ কোটি ইউরো ঋণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হচ্ছে।

দক্ষিণাঞ্চলের ১৯ জেলায় বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে খুলনার সুন্দরবন, বাগেরহাটের সাতক্ষীরা ষাটগম্বুজ মসজিদ, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, ঝালকাঠির পাথরঘাটা সমুদ্রসৈকত, বরিশালের সোনার চর, রূপার চর, ভোলার চর কুকরি মুরকি, ঝালকাঠির ভাসমান পেয়ারা বাজারসহ অসংখ্য পর্যটন স্থান রয়েছে। 

সেতু চালু হলে এগুলোতে সহজেই যাতায়াত করা যাবে। ফলে পর্যটকদের আগমন বাড়বে। এতে স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থান বাড়বে। নতুন নতুন শিল্প স্থাপন হবে

বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের ১৯ জেলায় দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিলাসবহুল বাস চলাচল করে না বললেই চলে। কিন্তু সেতু চালু হলে এসব বাস চলাচল করবে। তখন রাস্তার দুই পাশে বিলাসবহুল হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠবে। এছাড়া বিনোদন পার্কও গড়ে উঠবে।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেটের দিকে রাস্তার দুই পাশে নানা শিল্প গড়ে উঠেছে। এসব এলাকায় জমির দাম ও শ্রমের মূল্য বেশি হওয়ায় এখন অনেকেই শিল্প স্থাপন করতে আগ্রহী নন। পদ্মার ওপারে এ পারের তুলনায় জমি ও শ্রমের মূল্য এখনও কম। সেতুর ফলে পদ্মার ওপারে যাতায়াত সহজ হওয়া, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ মিলবে। এছাড়া উৎপাদিত পণ্য দ্রুত রপ্তানি করা যাবে। একই সঙ্গে পণ্য আমদানি খরচও কমবে। ফলে পদ্মার ওপারে বিনিয়োগের নতুন দুয়ার খুলবে।

এর বাইরে বৈদেশিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সেতু ভূমিকা রাখবে। বেনাপোল দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার দিয়ে মিয়ানমারে যাবে। এর সংযোগে ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু। এতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যও বাড়বে।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে নদীর দুই পারেই বহুমুখী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে দুই পারেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। বলা হয়, কোনো অঞ্চলে সরকার ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে অবকাঠামো নির্মাণ করলে বেসরকারি খাত শতগুণ বেশি বিনিয়োগ করে এর সুবিধা নেয়।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করেই এমনটি হবে বলে ভাবা হচ্ছে। পদ্মার দুই পারে ২টি করে চারটি স্যাটেলাইট টাউন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এগুলোতে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক জাদুঘর নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

এছাড়া প্রকল্প এলাকায় বিশ্বমানের অলিম্পিক ভিলেজ, বেনারসি, তাঁতপল্লী, রাজউকের উদ্যোগে আইকন টাওয়ার, দেশের মধ্যে একমাত্র ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমিসহ বড় বড় প্রকল্প নির্মিত হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ায় আর্থিক খাতের বিকাশও হবে দক্ষিণাঞ্চলে। বাড়বে অর্থনৈতিক সক্ষমতা। উন্নত হবে মানুষের জীবন যাত্রা। 

ক্রাইম ডায়রি // জাতীয়