প্রশ্নফাঁসঃ সেই বুয়েট শিক্ষকের ব্যাংক একাউন্টে দশকোটি টাকার লেনদেন

শিক্ষক প্রশ্নফাঁস করেছেন বিষয়টি শুনতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। একজন শিক্ষক এটা করতে পারে এটা অকল্পনীয় এবং অনৈতিক। তিনি ব্যবসায়ী নন। অথচ তার একাউন্টে দশকোটি টাকার লেনদেন প্রশ্নফাঁসের বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তুলেছেন। যদিও বিষয়টি তদন্তনাধীন। পরিপূর্ণ তদন্ত হবার মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস রোধ হোক এটাই এখন সময়ের দাবী।

প্রশ্নফাঁসঃ সেই  বুয়েট শিক্ষকের ব্যাংক একাউন্টে দশকোটি টাকার লেনদেন

অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধর নিয়োগ পরীক্ষা কমিটিতে না থাকলেও  প্রশ্ন ছাপার দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি  আশুলিয়ায় অবস্থিত আহসানিয়া মিশনের ছাপাখানায় অবস্থান করতেন। ফেরার সময় দুই কপি প্রশ্ন তিনি সঙ্গে আনতেন। প্রশ্ন ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ন দেলোয়ার হোসেন। গ্রেফতারের পর দেলোয়ার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিতে এই তথ্য জানিয়েছেন

মোঃ হেলাল উদ্দিনঃ

প্রশ্ন ফাঁসকারী সেই বুয়েট শিক্ষকের অ্যাকাউন্টে ১০ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য উদ্ধার করেছে গোয়েন্দারা। তার এই লেনদেন গত ৬ বছরে হয়েছে। একজন শিক্ষকের অ্যাকাউন্টে এত টাকা কোথা থেকে এলো? তিনি কোন ব্যবসায়ী নন এবং সেটা করার কোন সুযোগ ও নেই। অস্বাভাবিক এই অর্থের সন্ধান করতে গিয়ে গোয়েন্দারা প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে এই শিক্ষকের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন বলে জানা গেছে। 

রাষ্ট্রায়ত্ব পাঁচটি ব্যাংকের সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষা হয়। এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় যে শিক্ষকের নাম এসেছে তিনি বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান নিখিল রঞ্জন ধর। গোয়েন্দা পুলিশের কাছ থেকে তার বিষয়ে জানতে পেরে বুয়েট কর্তৃপক্ষ তাকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে বুয়েট সূত্রে জানা গেছে। 

বুয়েটের সম্মানিত ভিসি অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার ক্রাইম ডায়রিকে বলেন, ‘গোয়েন্দা পুলিশ আমাদের যোগাযোগ করে কিছু তথ্য দিয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই এই ব্যবস্থা। আমরা তদন্ত কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবস সময় দিয়েছি। তাদের রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশকেও বিষয়টি জানানো হবে।’

অবশ্য নিখিল রঞ্জন ধর তার বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগ অস্বীকার করে সাংবাদিকদের  বলেছেন, ‘প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই। দায়িত্ব থেকেই তিনি প্রেসে গেছেন এবং কাজটি তদারকি করেছেন।’

ছয় বছরে আপনার একাউন্টে ১০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। গত তিন বছরে সঞ্চয়পত্র কিনেছেন ১ কোটি ৮২ লাখ টাকার। এই টাকা কোথায় পেলেন? জানতে চাইলে এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি ১৯৮৬ সাল থেকে বুয়েটে শিক্ষকতা করি। এটা সারা জীবনের সঞ্চয়। পাশাপাশি পারিবারিকভাবে মাছের ঘের আছে। সেটাসহ কিছু ব্যবসাও আছে। সেখান থেকেও মাসে টাকা আসে। এসব টাকা দিয়েই আমি সঞ্চয়পত্র কিনেছি। সব টাকার হিসাব আছে।’

রাষ্ট্রায়ত্ব পাঁচ ব্যাংকের সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষার দায়িত্ব পেয়েছিল আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।  এই বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধর। গত ৬ নভেম্বর এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

কিভাবে এই শিক্ষকের নাম প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মধ্যে এল জানতে চাইলে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম  বলেন, ‘সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ব পাঁচ ব্যাংকের সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষার পর প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠে। তখন গোয়েন্দা পুলিশ এটা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। তদন্তের এক পর্যায়ে আমরা জানতে পারি আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস থেকেই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এই ঘটনায় আমরা ১১ জনকে গ্রেফতার করি। তাদের মধ্যে একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ওই শিক্ষকের নাম বলেছেন। পাশাপাশি আরও কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। এগুলো নিয়েই এখন আমাদের অনুসন্ধান চলছে। তিনি সম্পৃক্ত থাকলে আইনের আওতায় আনা হবে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে,  ‘অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধর নিয়োগ পরীক্ষা কমিটিতে না থাকলেও  প্রশ্ন ছাপার দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি  আশুলিয়ায় অবস্থিত আহসানিয়া মিশনের ছাপাখানায় অবস্থান করতেন। ফেরার সময় দুই কপি প্রশ্ন তিনি সঙ্গে আনতেন। প্রশ্ন ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ন দেলোয়ার হোসেন। গ্রেফতারের পর দেলোয়ার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিতে এই তথ্য জানিয়েছেন।’,

গোয়েন্দা সুত্রে জানা গেছে, এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও দিয়েছে।

অভিযোগ পাবার পর বুয়েটের এই শিক্ষকের বিষয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষ একটা উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে জানা গেছে।

মূলতঃ বুয়েট কমিটির রিপোর্টের পরই গোয়েন্দারা এই শিক্ষকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন বলে জানা গেছে। 

তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, একজন অধ্যাপকের একাউন্টে ৬ বছরে ১০ কোটি টাকার লেনদেন অস্বাভাবিক। আমরা এই টাকা উৎস খোঁজারও চেষ্টা করছি। সবকিছু একত্রিত হলেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান সাংবাদিকদের  বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত কাদের প্রশ্ন ছাপার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে সেটা ঠিকমতো দেখা। কারণ শুধু টেন্ডারে কেউ কম টাকা দিলেই তাকে কাজ দিতে হবে, এমনটি হওয়া উচিত না। তাদের সক্ষমতা আছে কী নেই সেটাও দেখা উচিত। আহসান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপাখানায় সিসি ক্যামেরাসহ ন্যূনতম নিরাপত্তাব্যবস্থাও নেই। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী দেলোয়ারের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ২ নভেম্বর আহছানিয়া মিশন ছাপাখানায় সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ছাপা হয়। সেদিন সকাল থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত নিখিল রঞ্জন ধর ওই ছাপাখানায় ছিলেন। আসার সময় প্রশ্নের দু'টি কপি তিনি নিয়ে যান। পাশাপাশি নজরদারি ও নিরাপত্তা না থাকায় দেলোয়ার নিজেও লুকিয়ে প্রশ্ন নিয়ে বের হতেন। তাকে সহযোগিতা করতেন টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান এবং ল্যাব সহকারী পারভেজ মিয়া। এভাবে তিনি পাঁচ-ছয়বার প্রশ্ন ছাপাখানা থেকে নিয়ে এসেছেন।

অভিযুক্ত  অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন বলেন,  বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ডাকে তিনি ছাপাখানায় যেতেন। পরীক্ষা কমিটিতে না থেকেও কেন যেতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূলতঃ পরীক্ষার সিটপ্ল্যান করতাম, অন্য শিক্ষকরাও থাকতেন। সবাই মিলে একসঙ্গে সিটপ্ল্যান তদারকী করতাম। আর ছাপা প্রশ্নে কোন ভুল আছে কিনা সেটা দেখার জন্যই দুই কপি ব্যাগে আনতেন। তার কাছ থেকে এটা বাইরে যায়নি বলে দাবী করেন তিনি।

ক্রাইম ডায়রি // ক্রাইম