দুবাইয়ে বৈধ বিনিয়োগ ৩৭ কোটি আর অবৈধ ১১ হাজার কোটি

দেশ থেকে কারা দুবাইয়ে কোন খাতে বিনিয়োগ করেছে সেগুলো অনুসন্ধান করে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে টাকা পাচার বন্ধ হবে না।

দুবাইয়ে বৈধ বিনিয়োগ ৩৭ কোটি  আর অবৈধ ১১ হাজার কোটি
ছবি- অনলাইন হতে সংগৃহীত

করোনার পর থেকে দেশটি থেকে বৈধপথে রেমিট্যান্স কমছে। কিন্তু অবৈধপথে বাড়ছে।

অনলাইন ডেস্কঃ

দুবাই এক স্বপ্ন শহরের নাম। যেখানে টাকা ওড়ে। মানুষ দুবাই যায় টাকা বানাতে। হ্যা, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক শহর দুবাই এর কথা বলছি।কি ব্যবসা; কি বিনোদন।আলাদা আমেজে ভরপুর এ শহরে বিনিয়োগের অফুরন্ত সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ফলে দুবাই এখন বিদেশিদের সেকেন্ডহোমের তালিকায় পছন্দের শীর্ষস্থানে।
এই শহরে বাংলাদেশের বহু  উদ্যোক্তা বৈধভাবে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৩৭ কোটি টাকা। কিন্তু চক্ষু চড়কগাছ হবে অবৈধভাবে বিনিয়োগের কথা শুনলে। দেশ থেকে অবৈধভাবে কামিয়ে আনা টাকা অবৈধভাবেই বিনিয়োগ হয়েছে এদেশে। আর এ বিনিয়োগ  প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে জানা গেছে। অন্যদিকে আমিরাতের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছেন ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। দেশটি থেকে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বৈদেশিক ঋণ নিয়েছেন ১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। অনলাইন গণমাধ্যম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন হতে  এই তথ্য জানা গেছে।প্রতিবেদনে অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বৈধভাবে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৩৩ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় ৩৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে এসব অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় ওই দেশে নেওয়া হয়েছে। দুবাই মূলত এখন আন্তর্জাতিক ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু। ফলে ওখানে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে অনেক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান শাখা অফিস খুলেছে।

এছাড়া দেশটিতে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী থাকেন। তাদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করার জন্য কয়েকটি ব্যাংক ওখানে শাখা খুলেছে। এসব খাতে বৈধভাবে বিনিয়োগ নেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুবাইয়ে বাংলাদেশের ১ লাখ ১৭ হাজার প্রবাসী রয়েছেন। তারা বিশেষ করে সে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িত। বেশিরভাগই শ্রমিক শ্রেণির। ফলে তারা আয়ের একটি বড় অংশ দেশে পাঠিয়ে সঞ্চয় করেন। আগে আমিরাত থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসত। এখন আর দেশটি রেমিট্যান্স পাঠানোর শীর্ষ তালিকায় নেই। নেমে এসেছে তৃতীয় স্থানে। করোনার পর থেকে দেশটি থেকে বৈধপথে রেমিট্যান্স কমছে। কিন্তু অবৈধপথে বাড়ছে।

এখন পর্যন্ত বিদেশে কর্মী যাওয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে আমিরাত। অক্টোবর-ডিসেম্বরে ১৮ হাজার কর্মী দেশটিতে গেছেন। জুলাই-সেপ্টেম্বরেও গেছেন ১৮ হাজারের বেশি। যা সবচেয়ে বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমিরাত থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৫৪ কোটি ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছে ২৪৭ কোটি ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছে ২৪৪ কোটি ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছে ২০৭ কোটি ডলার।

এভাবে প্রতিবছরই দেশটি থেকে রেমিট্যান্স কমছে। কিন্তু কর্মী যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তারপরও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। এর কারণ অনুসন্ধানে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি টিম আমিরাতে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে।

এতে বলা হয়, ব্যাংকিং সুবিধা না পাওয়া, বিনিময় হার কম, ব্যাংক রেমিট্যান্স সময়সাপেক্ষ, খরচ বেশি-এসব কারণে তারা ব্যাংকে রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন। বিপরীত দিক থেকে সেখানে হুন্ডি চক্র খুব বেশি সংঘবদ্ধ। তারা প্রবাসীদের আবাসস্থলে গিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে তাৎক্ষণিকভাবে দেশীয় এজেন্টের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করে। বিনিময়ে দুবাইর দিরহাম নিয়ে নিচ্ছে। এতে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দুবাই থেকে গড়ে প্রতি ত্রৈমাসিকে রেমিট্যান্স কমছে গড়ে ৩০ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবর-ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স কমেছে ৩৪ শতাংশ। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে বিনিময় হার ও আড়াই শতাংশ প্রণোদনাসহ যে অর্থ পান তারচেয়ে বেশি পান হুন্ডিতে।

এছাড়া করোনার পর থেকে দুবাইয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য গমনের মাত্রাও বেড়ে গেছে। কারণ ওখানে হুন্ডিতে টাকা পাঠানো খুব সহজ। এটিও একটি কারণ। আমিরাত থেকে গত এক বছরে রেমিট্যান্স কমেছে ৩৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরেও কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এসব রেমিট্যান্স হুন্ডিতে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মোট রেমিট্যান্সের ৪০ শতাংশ হুন্ডিতে এলে বছরে আসছে ৮০ কোটি ডলার। যেগুলো পরোক্ষভাবে দুবাইয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে। এর মধ্যে বড় একটি অংশ বিনিয়োগ হচ্ছে স্বর্ণ ব্যবসায়। এসব মিলে দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের পাচার করা অর্থ ১০০ কোটি ডলারের বেশি হবে। যা স্থানীয় মুদ্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০০৬ হতে গত জুন পর্যন্ত দুবাই থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ এসেছে ৫২ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এগুলো তেল, গ্যাস, খাদ্য, ব্যাংকিং, প্রযুক্তি খাতে এসেছে। দেশটি থেকে বাংলাদেশ পণ্য আমদানির নামে বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে ১২ কোটি ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দুবাইয়ে দুভাবে টাকা যেতে পারে। ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি ও রপ্তানির নামে এবং রেমিট্যান্সের অর্থ হুন্ডিতে এনে বৈদেশিক মুদ্রা দুবাইয়ে রেখে দেওয়া। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করলে অনেক কিছু ধরা সম্ভব। এছাড়া এগমন্ট গ্রুপের মাধ্যমেও এসব বিষয়ে তথ্য চাওয়া যেতে পারে। দেশ থেকে কারা দুবাইয়ে কোন খাতে বিনিয়োগ করেছে সেগুলো অনুসন্ধান করে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে টাকা পাচার বন্ধ হবে না।

তিনি বলেন, দেশে বিনিয়োগ ও আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত না হলে টাকা পাচার থামানো কঠিন হবে। সরকারকে আগে আস্থার পরিবেশ ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

সূত্র জানায়, আমিরাত সরকার সে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে করোনার পর বড় ছাড় দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের তথ্য গোপন রাখা হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ করলে ১০ বছরের গোল্ডেন ভিসা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে পরে স্থায়ী নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। বিদেশিদের জন্য সহজ শর্তে বাড়ি কেনার সুযোগও দেওয়া হচ্ছে। কানাডা, মালয়েশিয়ার পর এখন দুবাই এই তালিকায় চলে এসেছে। এসব কারণে দুবাইমুখী বিনিয়োগ বাড়ছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

ক্রাইম ডায়রি/ ক্রাইম