ব্রিটেনের রানি ক্যামিলার মাথায় উঠছে হীরার মুকুটঃ রাজা হলেন কিং চার্লস

ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর পরও কোহিনুর তখনও ইংল্যান্ডের রাজমুকুটে জায়গা পায়নি। ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্রাসাদে ‍দিলীপ সিংহের কাছ থেকে ব্যক্তিগত অনুরোধের মাধ্যমে এই কোহিনুর হীরা ফের উপহার হিসেবে নিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া। এর পরেই নিজের রাজমুকুটে কোহিনুর বসিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া।

ব্রিটেনের রানি ক্যামিলার মাথায় উঠছে হীরার মুকুটঃ রাজা হলেন  কিং চার্লস
ছবি- অনলাইন হতে সংগৃহীত

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর প্রথা অনুযায়ী ইংল্যান্ডের রাজা হয়েছেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র তৃতীয় চার্লস। তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শাসণ করা রানী।

ক্রাইম ডায়রি আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ

 ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী রাজশাসক রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।  ব্যালমোরাল প্রাসাদে প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর প্রথা অনুযায়ী ইংল্যান্ডের রাজা হয়েছেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র তৃতীয় চার্লস। তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শাসণ করা রানী।

চলতি বছরের শুরুতেই রানি এলিজাবেথ ঘোষণা করেছিলেন, তার অবর্তমানে ‘কুইন কনসর্ট’ হবেন চার্লসের স্ত্রী, ডাচেস অব কর্নওয়াল ক্যামিলা। তবে একজন সাধারণ নারী থেকে ‘কুইন কনসর্ট’ হতে ক্যামিলাকে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। বিশেষ করে প্রচণ্ড জনপ্রিয় প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে চার্লসের ডিভোর্সের পর নিজেকে চার্লসের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে ক্যামেলিয়াকে ডিঙাতে হয়েছে বিতর্কের পাহাড়। 

বছরের পর বছর ধরে, ক্যামিলা নিন্দিত হয়েছেন চার্লস-ডায়ানার রূপকথার রাজকীয় প্রেমের গল্পকে ভেঙে দেওয়ার জন্য। প্রিন্সেস ডায়ানাও ১৯৯৫ সালে বিবিসিকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছিলেন যে ‘এই বিয়েতে আমরা তিনজন ছিলাম’–তিনি,  চার্লস এবং তার দীর্ঘদিনের প্রেমিকা ক্যামিলা। এমনকি ডায়ানা তার প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বীকে ‘রটওয়েলার’ (বিশেষ জাতের কুকুর) বলেও অভিহিত করেছেন বলে কথিত আছে। 

যেভাবে ক্যামেলা হয়ে উঠল কুইনঃ

ব্রিটেনের অভিজাত পরিবারে ১৯৪৭ সালের ১৭ জুন ক্যামিলার জন্ম । আত্মবিশ্বাসী এবং আকর্ষণীয় ক্যামিলার সঙ্গে ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে একটি পোলো ম্যাচে তরুণী ক্যামিলার সঙ্গে প্রিন্স চার্লসের প্রথম দেখা হয়। পরে তারা ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। তবে চার্লসের সঙ্গে প্রথমবার সাক্ষাতের তিন বছর পর ১৯৭৩ সালে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তার অ্যান্ড্রু পার্কার বোলসের সঙ্গে বিয়ে হয় ক্যামিলার। তাদের বিয়েতে রাজকীয় অতিথিদের মধ্যে রানির বোন, রাজকুমারী মার্গারেট এবং রাজকুমারী অ্যানও উপস্থিত ছিলেন। 

বোলস-ক্যামিলার দুই সন্তানও আছে। যদিও ক্যামিলা-চার্লসের পরস্পরের প্রতি টান রয়েই যায়। এমনকি ১৯৮১ সালে প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে রাজকীয় বিয়ের পরও ক্যামিলাকে ভুলতে পারেননি চার্লস। গোপনে ক্যামিলা ও চার্লসের প্রণয় নিয়ে সেসময় অনেক কানাঘুষাও হয়। ১৯৯৫ সালে অ্যান্ড্রু পার্কার বোলস ও ক্যামিলার বিচ্ছেদ হয়। এর মাত্র এক বছর পর প্রিন্সেস ডায়ানা ও চার্লস তাদের সম্পর্কের ইতি টানেন। 

১৯৯৭ সালে প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানা মৃত্যুর পরও চার্লস ও ক্যামিলা তাদের সম্পর্ককে চেপেই রেখেছিলেন। এরপর চার্লস এবং ক্যামিলা ধীরে ধীরে জনসমক্ষে একসঙ্গে উপস্থিত হতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসে যে তারা স্বামী ও স্ত্রী হিসাবে একসাথে বসবাস করছেন।

কয়েক মাস সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পনা করার পর, ১৯৯৯ সালে তারা প্রথম জনসাধারণের সামনে আসেন। তারপরে তাদের সম্পর্ক নিয়ে আর কোনো রাখঢাকই থাকে না। এক সময় তাদের জুটিকে হিসেবে সবাই মেনেও নেয়। ২০০৫ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদের বিয়েতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও উপস্থিত ছিলেন। 

অবশ্য চার্লসের সঙ্গে বিয়ের পরও রয়ে যায় ক্যামিলার উপাধি নিয়ে বিতর্ক। যদিও ঐতিহ্যগতভাবে রাজার স্ত্রী হলেন রানি। কিন্তু চার্লস রাজা হলে ক্যামিলার উপাধি কী হবে তা বছরের পর বছর ধরে একটি বড় প্রশ্ন ছিল। রাজতন্ত্রে তার অবস্থান সবসময়ই একটি সংবেদনশীল বিষয় ছিল। প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর পর চার্লসের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে রাজতন্ত্রে ক্যামিলার অবস্থান সব সময়ই একটি সংবেদনশীল বিষয় ছিল।

প্রাসাদের কর্মকর্তারা বছরের পর বছর ধরে বলেছিলেন যে, চার্লস রাজা হলে ক্যামিলাকে সম্ভবত ঐতিহ্যবাহী ‘রানি কনসর্ট’ এর পরিবর্তে ‘রাজকুমারী কনসর্ট’ উপাধি দেওয়া হবে।

রাজ প্রাসাদের কর্মকর্তাদের মতে, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে ‘প্রিন্সেস কনসর্ট’ উপাধির কোনো উদাহরণ নেই। একই ধরনের উপাধি ‘প্রিন্স কনসর্ট’ শুধুমাত্র একবার রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্টের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, তার ছেলে প্রিন্স চার্লস রাজা হলে ক্যামিলাকে ‘কুইন কনসর্ট’ উপাধি দেওয়া হবে। এরপরই এই নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়। এমনকি চার্লসের রাজা হিসেবে অভিষেকের সময় ক্যামিলার মাথায় উঠবে কোহিনুর বসানো মুকুট। 

হীরের মুকুটঃ

হীরাটি ১০৫.৬ মেট্রিক ক্যারাটের, ওজন ২১.৬ গ্রাম। ১১০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের এক খনিতে পাওয়া যায় এই হীরা।  এরপর বিশ্বে এসেছে নানা রদবদল, খোলনলচে পাল্টে গেছে কোনো কোনো দেশের ইতিহাস।  বদল এসেছে বিশ্ব মানচিত্রেও।  কিন্তু আলোচিত সেই কোহিনুর হীরা কালের সাক্ষী হিসেবে শোভা বাড়িয়ে চলেছে ইংল্যান্ডের রানির মুকুটের। 

রানির মৃত্যুর পর ব্রিটেনের পরবর্তী রাজা হচ্ছেন চার্লস। তাই প্রশ্ন ওঠছে কোহিনুর হিরে নিয়েও। এত বছর ধরে রানির মুকুটে শোভা পেত কোহিনুর। এখন তা শোভা পাবে কোথায়? চলতি বছরের শুরুতেই রানি এলিজাবেথ ঘোষণা করেছিলেন, তার অবর্তমানে ‘কুইন কনসর্ট’ হবেন যুবরাজ চার্লসের স্ত্রী, ডাচেস অব কর্নওয়াল ক্যামিলা। চার্লসের রাজা হিসেবে অভিষেকের সময় ক্যামিলার মাথায় উঠবে সেই কোহিনুর বসানো মুকুট।

ইতিহাসের সাক্ষী এই হীরের মুকুটঃ

শতকের পর শতক পার হতে হতে কোহিনুর সাক্ষী থেকেছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনার। বহু ঐতিহাসিক যুদ্ধকে চাক্ষুষ করেছে এই মূল্যবান হীরা। দেখেছে দরবারের জটিল কূটনীতি, সিংহাসন বদলও। এই কোহিনুরকে ঘিরে রয়েছে বহু বিতর্ক, চলেছে মামলাও।কথিত আছে, ১৩১০ সালে কাকোতীয় বংশের সঙ্গে বরঙ্গলের যুদ্ধে এই হিরে দখল করেন দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। পরে তা হাতবদল হয়ে আসে মুঘল দরবারে। 'বাবরনামা'য় উল্লেখ রয়েছে, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের যুদ্ধে তা বাবরের দখলে আসে।

সপ্তদশ শতকে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের দরবারে ময়ূর সিংহাসনে শোভা পেত কোহিনুর। পার্সি ভাষায় ‘কোহিনুর’ শব্দের অর্থ 'আলোর পর্বত' (মাউন্টেন অব লাইট)। ১৭৩২ সালে নাদির শাহ মুঘল সাম্রাজ্য আক্রমণ ও দিল্লি লুণ্ঠন করে ময়ূর সিংহাসনের সঙ্গে কোহিনুর হিরেটিকেও নিয়ে যান ইরানে। পরে দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হন নাদির শাহ।

নাদির শাহের পর আহমদ শাহ দুররানি কোহিনুর হস্তগত করেন। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, নাদির শাহের নাতি নিজেই দুররানিকে এই হীরাটি উপহার দিয়েছিলেন। ১৮১৩ সালে দু্ররানি পঞ্জাবের সিংহাসন হারলে তা ‘শের-ই-পঞ্জাব’ মহারাজা রঞ্জিত সিংহের হাতে আসে। তিনি নাকি এই বহুমূল্য হিরে তার পাগড়িতে আটকে রাখতেন।

রঞ্জিত সিংহের পর এই হীরার মালিকানা লাভ করেন নাবালক মহারাজা দিলীপ সিংহ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পঞ্জাবে তাদের ঘাঁটি গড়লে শুরু হয় কোহিনুরের পরবর্তী অধ্যায়। ১৮৪৯ সালে লর্ড ডালহৌসি ও মহারাজ ‍দিলীপ সিংহের মধ্যে লাহোর চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির শর্তানুসারে ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়াকে কোহিনুর হীরে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন লাহোরের মহারাজ।

ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর পরও কোহিনুর তখনও ইংল্যান্ডের রাজমুকুটে জায়গা পায়নি। ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্রাসাদে ‍দিলীপ সিংহের কাছ থেকে ব্যক্তিগত অনুরোধের মাধ্যমে এই কোহিনুর হীরা ফের উপহার হিসেবে নিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া। এর পরেই নিজের রাজমুকুটে কোহিনুর বসিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া।

পরবর্তী কালে এই হীরা ভারতবর্ষে ফেরানোর অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ২০১৯ সালে পাকিস্তানও এই হিরে ফেরত চেয়ে নিজেদের দাবির কথা জানিয়েছিল ইংল্যান্ডের কাছে।

পাকিস্তানের যুক্তি, লাহোর ছিল শিখ সাম্রাজ্যের রাজধানী। লাহোর চুক্তির মাধ্যমেই কোহিনুর নিজেদের হেফাজতে নেয় ইংল্যান্ড। তাই এই হীরা ফেরত আসবে লাহোরেই। লাহোর জাদুঘরে ঠাঁই পাবে কোহিনুর— এমনটাই জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী।

ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া বিশ্ববিখ্যাত কোহিনুর ইংল্যান্ডের কাছ থেকে চাওয়া সম্ভব নয়, এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা খারিজও করে দেয় ভারতের শীর্ষ আদালত। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ জানিয়েছিল, ইংল্যান্ডের কাছ থেকে এই হীরা ফেরত চাওয়ার দাবির পিছনে কোনো আইনগত যুক্তি নেই। ১৯৩৭ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জের অভিষেকের সময় প্ল্যাটিনামের মুকুটে বসানো হয়েছিল কোহিনুর। সেই মুকুট পরেছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথের মা ‘কুইন মাদার’ এলিজাবেথ।

তার পরে তা রানি এলিজাবেথের কাছে আসে। টাওয়ার অব লন্ডনে রাখা থাকে সেই মুকুট। এখন সেই কোহিনুরখচিত মুকুটই শোভা পাবে চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলার মাথায়। 

ক্রাইম ডায়রি/ আন্তর্জাতিক