দূর্নীতিই যখন ব্যবসার মূল বাঁধাঃসিপিডি কর্তৃক ব্যবসায়ী জরিপ

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, র‌্যাবের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এর প্রভাব ব্যবসাবাণিজ্যে পড়লে বড় মূল্য দিতে হবে। তবে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ভিশন দেশের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

দূর্নীতিই যখন ব্যবসার মূল বাঁধাঃসিপিডি কর্তৃক ব্যবসায়ী জরিপ
আগামী ২ বছরে অর্থনীতির জন্য পাঁচটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো-বিশ্ব অর্থনীতির চাপ, ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা, পরিবেশগত, সামাজিক এবং প্রযুক্তিগত ঝুঁকি। আর ব্যবসায় খরচ কমাতে আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে দুর্নীতি কমাতে হবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, র‌্যাবের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এর প্রভাব ব্যবসাবাণিজ্যে পড়লে বড় মূল্য দিতে হবে। তবে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ভিশন দেশের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
শাহাদাত হোসেন রিটনঃ
facebook sharing buttonwhatsapp sharing buttonবেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ব্যবসায়ী জরিপ করেছে। সেখানে উঠে এসেছে কিছু গুরুত্বপূর্ন
 তথ্য। জরিপে দেখা গেছে, দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের পথে প্রধান অন্তরায় তিনটি হলোঃ- দুর্নীতি, অদক্ষ প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং পুঁজির সীমাবদ্ধতা। এছাড়া উচ্চ আয়কর, মূল্যস্ফীতি এবং বিভিন্ন বিলের কারণে ব্যবসায় ব্যয় বাড়ছে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা নেই। বাড়ছে টাকা পাচার। এসব বিষয়ের সামগ্রিক প্রভাবে টিকে থাকতে পারছে না শিল্প-প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে কমপক্ষে তিন বছর সময় লাগবে। আর আপাতত টিকে থাকতে গবেষকরা  খরচ কমানোর উপর জোর দিচ্ছেন।
 
জানুয়ারী ২৬,২০২২ইং বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এবং গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি পড়ে শোনানো হয়। সেখানে জানানো হয়, আগামী ২ বছরে অর্থনীতির জন্য পাঁচটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো-বিশ্ব অর্থনীতির চাপ, ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা, পরিবেশগত, সামাজিক এবং প্রযুক্তিগত ঝুঁকি। আর ব্যবসায় খরচ কমাতে আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে দুর্নীতি কমাতে হবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, র‌্যাবের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এর প্রভাব ব্যবসাবাণিজ্যে পড়লে বড় মূল্য দিতে হবে। তবে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ভিশন দেশের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীদের মতে, এসব কারণে বাংলাদেশের ব্যবসার ব্যয় বাড়ছে। ফলে উল্লেখযোগ্য অংশ বাজারে টিকে থাকতে পারছে না। ব্যবসায় টিকে থাকতে ২৮ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যয় কমানোর কথা বলছে। নতুন ক্রেতা খোঁজার কথা বলছে ২২ শতাংশ। ১৯ শতাংশ বলছে, ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা এবং রপ্তানি নতুন বাজার খোঁজার আগ্রহী মাত্র ১৬ শতাংশ ব্যবসায়ী। ১৫ শতাংশ বলছে নতুন পণ্য। এসব ব্যবসায়ী বলছেন, করোনা থেকে উত্তরণের কথা বলা হলেও কমপক্ষে ৩ বছরের আগে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। ৪২ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করে, বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ রয়েছে। 

ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা ২০২১ সালে বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে মোট ১৬টি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে বড় সমস্যা তিনটি। ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করে, ব্যবসা করার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা দুর্নীতি। বিশেষ করে মাঝারি, ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ৮৩ ভাগই দুর্নীতিকে বড় সমস্যা মনে করে। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকা উচিত। ৬৭ শতাংশ মনে করে, অদক্ষ প্রশাসন অন্যতম সমস্যা।

পুঁজির সংগ্রহে নানা সীমাবদ্ধতার কথা বলেছে ৫৪ শতাংশ। ৪৫ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে অন্যতম সমস্যা অবকাঠামো। এছাড়াও ৩৬ শতাংশ বলছে, নীতির ধারাবাহিকতা এবং ৩৪ শতাংশের মতে উচ্চ কর। এছাড়াও ব্যবসায়ীরা যেসব সমস্যার কথা বলছে সেগুলো হলো করের নীতিতে জটিলতা, অদক্ষ জনবল, পর্যাপ্ত উদ্ভাবনের অভাব, বিভিন্ন অপরাধ ও চুরি, সরকারের অস্থিতিশীলতা, নৈতিকতা, মূল্যস্ফীতি এবং শ্রম আইনের সীমাবদ্ধতা।

অন্যদিকে ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে, আগামী ১০ বছরে দেশের ব্যবসাবাণিজ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হবে ডিজিটাল সেবা। এছাড়াও ডেটা বিজনেস এবং প্লাস্টিক রিসাইক্লিং অন্যতম। অন্যদিকে আগামী ২ বছরে বৈশ্বিক ৫টি ঝুঁকি বাংলাদেশকে প্রভাবিত করবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি। বড় দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশের যে ঋণ রয়েছে, তা অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে এবং  শিল্পে বিপর্যয় আসবে। দ্বিতীয়ত, ভূ-রাজনৈতিক কিছু সমস্যা সৃষ্টি হবে।

চতুর্থ সমস্যা সামাজিক। বিপুলসংখ্যক লোকের বেকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়াও অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন রোগ এবং নিরাপত্তা অন্যতম। ব্যবসায়ীদের বিবেচনায় আগামী ২ বছরে সর্বশেষ সমস্যা হবে প্রযুক্তিগত ঝুঁকি। তাদের মতে, ডিজিটাল প্রযুক্তির কথা বলা হলেও ডিজিটাল কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সে ১১০টি দেশের মধ্যে ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৩। অন্যদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে।

সব ব্যবসায়ী এসব সুযোগ সমানভাবে পান না। ক্ষমতাশালী এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর কাছে এগুলো জিম্মি হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। আগামী দিনে শ্রমশক্তি দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়াও ব্যবসাবাণিজ্য নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর হাতে চলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে খাতভিত্তিক বড় গ্রুপ তৈরি হচ্ছে, যা সাধারণ ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ব্যবসায় খরচ কমাতে আমদানি-রপ্তানির পর্যায়ে দুর্নীতি কমাতে হবে।

পাশাপাশি স্বচ্ছতা বাড়াতে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্টসহ অন্য আইনগুলো কার্যকর করতে হবে। তিনি বলেন, ট্যাক্সের সুবিধাগুলো যাতে ব্যবসায়ীদের কাছে আরও সহজে পৌঁছানো যায়, সেজন্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সিস্টেমের উন্নয়ন করতে হবে। তার মতে, ব্যবসা করার জন্য একটি ফুল প্যাকেজ দরকার। এর মধ্যে রয়েছে জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, শ্রমিক, স্বল্প সুদে ঋণ এবং বন্দরের সুবিধা। কিন্তু সেটি এখনো দেওয়া সম্ভব হয়নি, যা বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এছাড়াও অবকাঠামো খাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে, এর পুরো সুবিধা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। সরকারের প্রশাসন-যন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, ব্যবসায়ীদের মতে, জনসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও দুর্নীতি রয়েছে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন দরকার। এছাড়াও করোনা পরিস্থিতিসহ সামগ্রিক বিষয়ে উত্তরণে একটি পূর্ণাঙ্গ পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা দরকার। আগামী বাজেটে এ বিষয়ে ঘোষণা থাকতে হবে।

প্রায় পচাত্তর জন  ব্যবসায়ীর উপর এই জরিপ চালায় সিপিডি। তাদের মতামতের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এর মধ্যে বড় ব্যবসায়ী ৩৯ জন, মাঝারি ১৭, ছোট ১২ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ৫ জন। তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও ফরিদপুর। তবে যেসব ব্যবসায়ীর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদেরকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

ক্রাইম ডায়রি// অর্থ-বানিজ্য