মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি কমিশনের সব কর্মকর্তার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে তারা যেন সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতা প্রদর্শন করেন। অন্যের দুর্নীতি চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার আগে নিজেদের অনিয়ম ও অসততা দূর করতে হবে ।
আতিকুল্লাহ আরেফিন রাসেলঃ
দুদক নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি আশির্বাদ। ফাইল দূর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্যে মানুষ যখন দিশেহারা তখন দুদক অফিসিয়াল দূর্নীতি বন্ধের চেষ্টা করায় কোটি মানুষের দোয়ায় সিক্ত হয়েছে। লুটপাট, চুরি কিংবা ঘুষ ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুদকের সাফল্য ঈর্ষনীয়। বঙ্গকন্যা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নিজ ঘর হতে দূর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটদের উপর আঘাত হানায় নিঃসন্দেহে সোনার বাংলা গড়ার নেপথ্যে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের নির্দেশনা মানতে ‘হার্ডলাইনে’ কার্যক্রম শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
"দুদকের প্রতি রাষ্ট্রপতির যে নির্দেশনা দিয়েছেনঃ ডিসেম্বর ৯,২০২১ইং আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভিডিও বার্তায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেন, একজন দুর্নীতিবাজের পরিচয় শুধুই দুর্নীতিবাজ।
যে দলেরই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। দুদককে দুর্নীতি দমনে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি আশা করব, আপনারা নিজেদের ঘর থেকে অভিযান শুরু করবেন। কিছুসংখ্যক লোকের জন্য যাতে পুরো কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবেন।
তিনি বলেন, আমি কমিশনের সব কর্মকর্তার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে তারা যেন সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতা প্রদর্শন করেন। অন্যের দুর্নীতি চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার আগে নিজেদের অনিয়ম ও অসততা দূর করতে হবে।
যারা রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব ও ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হবে এবং অপরাধ করে কেউ পার পাবে না-জনমনে এমন ধারণা জন্মাতে পারলেই দুদকের ওপর জনগণের আস্থা বাড়বে।"
ঘরোয়া দুর্নীতি নির্মূল করতে ইতোমধ্যে কমিশন নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এক-চতুর্থাংশ অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের কোনো গাফিলতি কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এজন্য প্রায় চব্বিশজন কর্মকর্তাকে তলব করে কৈফিয়ত নেওয়া হয়েছে।
কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রমাণ পেলে ‘দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা ২০০৮’-এর ৫৪ ধারায় ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও অসদাচরণের অভিযোগে এক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। এদিকে কমিশনের এই অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নির্মূলের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশবরেণ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যে কোনো কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে কমিশনকে এই অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নির্মূলে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন সেনাবাহিনীর আদলে ঘরোয়া দুর্নীতি রোধে ইন্টারনাল গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এর আগে দুদককে নিজ ঘর থেকে অভিযান শুরুর নির্দেশনা দেওয়া হয়। ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস-২০২১’ উপলক্ষ্যে ভিডিও বার্তায় রাষ্ট্রপতি ওই নির্দেশনা দেন।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দুদকে যারা কাজ করে, তারা এই সমাজেরই মানুষ এবং মানুষ হিসেবে অবশ্যই ভূল ত্রূটির উর্ধ্বে নয়। সমাজে যেমন ভালো-মন্দ আছে, দুদকেও তেমন ভালো-মন্দ রয়েছে। সমাজকে পরিশুদ্ধ করার জন্য দুদক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই দুদক কর্মকর্তাদের নিজেদের পরিশুদ্ধ রাখতে হবে।
অন্যায় করলে শাস্তি দুদকেও হয়। তিনি বলেন, সাম্প্রতিককালে একজন পরিচালক দুর্নীতির দায়ে জেলেও গেছেন। দুদক যে কার্যক্রম শুরু করেছে, এটা অত্যন্ত ভালো কাজ। এটাকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি। তবে এ কাজকে আরও বেগবান করতে কমিশনকে নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের ওপর একধরনের গোয়েন্দাগিরি করতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন সময় যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছেন, সেগুলো আমরা পালন করার চেষ্টা করছি। একদিনে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নির্মূলের কথা বলেছেন। আমরা অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নির্মূলের ক্ষেত্রে আইনে যতটুকু সাপোর্ট করে, ততটুকু মেনে কাজ করছি। একদিনে সব হয়ে যাবে-সেই প্রত্যাশাও করি না। তবে আমাদের ইচ্ছা আছে। আমরা সে অনুসারে উদ্যোগও নিচ্ছি। আশা করছি, ভালো ফল পাব।
ডিসেম্বর ২২,২০২১ইং বুধবার দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার সাংবাদিকদের বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো নিয়ে কমিশনের ত্রৈমাসিক সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা বাস্তবায়নে কমিশন কাজ করে চলেছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাষ্ট্রপতি বক্তব্য সুন্দর নির্দেশনামূলক । দুদকে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি চলে। অনেক সময় দুদক নিজেও তা প্রকাশ্যে না হলে গোপনে স্বীকার করেছে। এ শাস্তি যেন শুধু বদলি কিংবা বিভাগীয় ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। সরকারি কর্মকর্তা হলেও আইনের চোখে সবাই অপরাধী। দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় ও জবাবদিহিতায় আনতে পারলে রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা অনুসারে কমিশনের এ উদ্যোগের সুফল পাওয়া যাবে।
শৃঙ্খলা ভঙ্গে ৫৪ ধারায় ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে দুদকের এক-চতুর্থাংশ অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমই মেয়াদোত্তীর্ণ। বিদ্যমান আইনের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ অনুসন্ধান এবং ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ মোট অনুসন্ধান ও মামলার তদন্তের হার ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।
চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দুদকের মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ১১১৯টি এবং মেয়াদোত্তীর্ণ তদন্ত ২০৩টি। এসব অনুসন্ধান ও তদন্তের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে সম্প্রতি প্রায় দুই ডজন কর্মকর্তাকে তলব করে কারণ জানতে চেয়েছে কমিশন।
জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে যদি কোনো কর্মকর্তা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন তবে তার বিরুদ্ধে দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা ২০০৮-এর ৫৪ ধারা অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। ৫৪ ধারায় চাকরির অবসানের কথা বলা হয়েছে।
এ ধারায় বলা হয়, ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ (কমিশন) কোনো কারণ প্রদর্শন না করে এবং এক মাসের নোটিশ দিয়ে অথবা ওই নোটিশের পরিবর্তে এক মাসের বেতন দিয়ে কোনো শিক্ষানবিশের চাকরির অবসান ঘটাতে পারবে এবং শিক্ষানবিশ তার চাকরি অবসানের কারণে কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না।’ মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও তদন্তের পাশাপাশি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আসা যে কোনো অভিযোগই গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিচ্ছে কমিশন।
মহামান্য রাষ্ট্রপতির এমন নির্দেশনাকে বাহবা জানিয়েছেন দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কমিশনের এই ৫৪ ধারা ব্যবহারের নির্দেশনাতে কর্মকর্তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা গেছে।
অনেকে মনে করছেন, কাজ করলে ভুলতো হতেই পারে। যারা কাজ করেনা তাদের ভুল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা ২০০৮-এর ৫৪ ধারা অনুসরণ করার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার শঙ্কা রয়েছে।
তবে বিধিমালার ৩৮ ধারা অনুসরণে কোনো বাধা নেই। সেখানে ‘আচরণ ও শৃঙ্খলার’ কথা বলা হয়েছে। আর ৪০ ধারায় ‘লঘু ও গুরুদণ্ডের’ কথা বলা আছে। সে অনুসারে শৃঙ্খলাভঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যৌক্তিক।
৫৪ ধারা অনুসরণে একজন কর্মকর্তা তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগটুকুও পাওয়া যায় না। ফলে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পর কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক কাজ করছে। এজন্য কাজ না করে একধরনের ‘হাত-পা গুটিয়ে’ রেখেছেন তারা।
জানা গেছে সম্প্রতি দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ১৫ ডিসেম্বর এ বিষয়ে একটি অফিস আদেশ জারি করেন। সেখানে বলা হয়েছে, মো. সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে তার স্ত্রীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এবং পেনাল কোডের ৩২৩ ধারায় যৌতুকের টাকার জন্য মারধর ও জখমের অভিযোগ করেছেন।
তিনি ফৌজদারি অপরাধের এ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালত থেকে জামিন পেলেও বিষয়টি কমিশনকে অবহিত না করে গোপন রাখেন। যেহেতু উপরিউক্ত কার্যকলাপে দুর্নীতি দমন কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাই কমিশনের (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর ৩৯(খ) অনুযায়ী, অসদাচরণের আওতায় অবিলম্বে তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা যুক্তিযুক্ত ও অপরিহার্য।
সেহেতু কমিশনের চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, মো. সালাহউদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। এমন উদ্যোগকেও সাধুবাদ জানিয়েছেন বিজ্ঞমহল। অভিজ্ঞজনেরা মনে করছেন, দুদক যেহেতু সকলের অপরাধ ধরে সুতরাং তাদের হতে হবে সাদা কাপড়ের ন্যায়। কালি লাগলে যেমন সাদা কাপড় মূল্যহীন তেমনি দাগ লাগলে দুদকের মর্যাদাও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তাই দুদকে স্বচ্ছতা জরুরী।
ক্রাইম ডায়রি / জাতীয়