অজানা রোগ হতে মুক্তি পেতে নদী বাঁচান,প্রকৃতি বাঁচান
নদী খেকোরা বেপরোয়া। এ দৃশ্য শুধু শহরের নয়, গ্রামেরও। মাটি খেঁকো,নদী খেঁকোরা এখন গ্রামমুখী।
বিভিন্ন মিডিয়ায় একই খবর প্রচারের কারণে আমাদের বিশ্বাস জন্মেছে, শুধু শহরেই বুঝি নদনদী-খালবিল দখল হয়ে গেছে। এই দখল প্রক্রিয়া যে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, আমরা কি এর খোঁজ রাখি?
ক্রাইম ডায়রি ডেস্কঃ
বিভিন্ন মিডিয়ায় একই খবর প্রচারের কারণে আমাদের বিশ্বাস জন্মেছে, শুধু শহরেই বুঝি নদনদী-খালবিল দখল হয়ে গেছে। এই দখল প্রক্রিয়া যে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, আমরা কি এর খোঁজ রাখি?
দেশে একসময় সহস্রাধিক নদনদী জালের মতো ছড়িয়ে ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির কারণে সেগুলো দখল হয়ে গেছে। আগে যোগাযোগব্যবস্থা ছিল নদীকেন্দ্রিক। সে কারণে নদীবন্দরকে ঘিরে শহর গড়ে ওঠে।
ঢাকার চারদিকে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল অনেক খাল। স্বভাবতই নৌপথে মালামাল পরিবহণের সুবিধার্থে মোগলরা ঢাকায় শহর প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। শুধু ঢাকা কেন, অনেক শহরেরই মাঝ বা পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে।
পাবনায় ইছামতী, ময়মনসিংহে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র, বগুড়ায় করতোয়া, কুষ্টিয়ায় গড়াই, যশোরে ভৈরব এর উদাহরণ। আর বরিশালকে তো বলা হয়-নদ-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। দেশের বৃহৎ নদী হিসাবে পরিচিত পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, শীতলক্ষ্যা, গোমতী ইত্যাদি। এই নদীগুলোর সঙ্গে সহস্রাধিক ছোট ছোট নদনদীর সংযোগ ছিল। সেজন্য বলা হয়-নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।
পরিতাপের বিষয়, বহু ছোট নদীর উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নদীগুলো পরিত্যক্ত ও ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বহু নদী ভরাট করে আবাসন শিল্প গড়ে তোলা হয়েছে। একসময় ঈশ্বরদীর পাশ দিয়ে কমলা নদী প্রবাহিত ছিল।
এই নদীটির মৃত্যুকাহিনিই বলে দেবে অন্যান্য নদীর কীভাবে মৃত্যু ঘটেছে। যত দূর জানা যায়, পাকশী-বাঘৈল এলাকার একজন রাজার কন্যার নামানুসারে কমলা নদী। এটি পদ্মা নদীর সাঁড়া এলাকা থেকে উৎপত্তি হয়ে স্কুলপাড়া দিয়ে রেলগেটের উত্তর পাশ হয়ে কৃষি ফার্মের ভেতর দিয়ে অরনকোলার দোহায় গিয়ে মেশে। তারপর মুলাডুলির কৃষি ফার্মের ভেতর দিয়ে বড়াই গ্রাম উপজেলার রাজাপুর হাটের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গারফা চিকনাই নদীতে গিয়ে মিশেছে।
চিকনাই নদীটি চলনবিলে গিয়ে শেষ হয়। ব্রিটিশরা রেললাইন নির্মাণ করার সময় কমলা নদীর প্রবাহকে সামনে রেখে ঈশ্বরদী রেলগেটের কাছে বেশ প্রশস্ত একটি রেল সাঁকো নির্মাণ করে। পাকিস্তান আমলে আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের জন্য জমি হুকুমদখল করা হয়।
তখন কৃষি মন্ত্রণালয় কমলা নদীর প্রবাহের জন্য একটি খাল নির্মাণ করে, যা সবুজকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন থেকে অরনকোলা হাট পর্যন্ত এখনো দৃশ্যমান রয়েছে। ১৯৭৭-১৯৭৮ সালেও পশ্চিম টেংরি স্কুলপাড়া থেকে রেল সাঁকোর নিচ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে নদীতে পানি প্রবাহিত হতে দেখেছি। পৌর চেয়ারম্যানদের গাফিলতি ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় নদীটি প্রাণ হারায়।
উল্লেখ্য, সাঁড়া ইউনিয়ন, ঈশ্বরদী পৌরসভা, মুলাডুলি ইউনিয়নসহ যেসব এলাকা দিয়ে নদীটি প্রবাহিত হয়েছে, সেসব এলাকার জমির মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। স্থানীয় পর্যায়ে সেসব জমি রক্ষার জন্য এসি (ল্যান্ড), ইউএনও, এডিসি, ডিসি পদাধিকারী সরকারি কর্মকর্তারা রয়েছেন। সেজন্য দেখা যায়, পাবনায় কোনো নতুন ডিসি বদলি হয়ে এসেই প্রথমে ঘোষণা দেন-‘আমার প্রথম দায়িত্ব হলো ইছামতীকে রক্ষা করা।’ কিন্তু কোনো ইউএনও কি বলেছেন, তিনি কমলা নদী উদ্ধার করবেন?
নদীটি বর্তমানে পাঁচ ফুট প্রশস্ত ড্রেনে পরিণত হয়েছে। এর উভয় পাশে বহু হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে/হচ্ছে। নদীটির উৎসমুখ বহু আগেই ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ঈশ্বরদী শহর ক্রমবর্ধমান।
২০৫০ সালের আগে কিংবা পরে সমগ্র দেশটি নগরায়ণ হয়ে যাবে। নগর হলো সভ্যতার স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। এ সভ্যতা দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে। সেজন্য মহাপরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু ঈশ্বরদীর পয়ঃনিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা কীভাবে দূর হবে, কীভাবে এর স্থায়ী সমাধান হবে, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ভাবছেন কি? সচেতন মহলের দায়িত্ব পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়ণের স্বার্থে দেশের ছোট নদীগুলো উদ্ধারে সোচ্চার হওয়া।
মোশাররফ হোসেন মুসা : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক
ক্রাইম ডায়রি // স্পেশাল