আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে তেলের দামঃ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেওঃ দেশব্যাপী মজুদদারের গোডাউনে অভিযান

শুধু ব্যবসায়ীরাই মজুদ করছেন এমনও নয়। মজুদ করছেন গৃহকর্তারাও ফলে সাধারন মানুষ বাজারে গিয়ে তেল পাননা। করোনার সময় ও এমন হয়েছেল । কিছু মানুষের মানসিকতাই এমন পরে যদি না পাওয়া যায় আগেভাগেই কিনে কিনে ঘর বোঝাই করে রাখে। ফলে বাজারে সাময়িক কৃত্রিম সংকট তৈরি হয় আর এর মাশুল গুনতে হয় সাধারন মানুষকে।

আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে তেলের দামঃ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেওঃ দেশব্যাপী মজুদদারের গোডাউনে অভিযান
ছবি-ক্রাইম ডায়রি

পাশাপাশি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহণ ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে পামতেলের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন অপরিশোধিত সয়াবিন ২ হাজার মার্কিন ডলার ও পাম অয়েল এক হাজার ৯৫০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। মূলত এসব কারণে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে।

শরীফা আক্তার স্বর্নাঃ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু হতেই সারাবিশ্বেই বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছ। তেলের বাজারেও যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল।  এরই ধারাবাহিকতায় যথেষ্ট মজুদ থাকার পরও শুধু মাত্র মজুদদারদের মানসিকাতর কারনে বাজারে তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় মূল্যবৃদ্ধির সাতটি কারন খুঁজে পেয়েছেন।  গত ৫ মে আবারও তেলের দাম সমন্বয় করে নতুন দরও নির্ধারণ করে দিয়েছেন তারা।

তবে আরও দাম বাড়বে এমন আগাম তথ্যের ভিত্তিতে অতি মুনাফা করতে খুচরা ও পাইকারি ডিলাররা তেলের অবৈধ মজুদ করে, লুকিয়ে রেখে  কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছেন। ফলশ্রুতিতে কয়েক দিন তেলশূন্য হয়ে পড়ে বাজার। পণ্যটি না পেয়ে ক্রেতাদের ফিরতে হয় খালি হাতে। আর যেখানে পাওয়া গেছে গুনতে হয়েছে বাড়তি টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। সংকট উত্তোরনে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল জব্দ ও জরিমানা আদায় করেছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।

যুদ্ধ ছাড়াও যে কারনে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে তেলের দামঃ

মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-পাম তেলের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ মালয়েশিয়ায় শ্রমিকস্বল্পতার কারণে পাম অয়েলের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সানফ্লাওয়ার অয়েলের সরবরাহ ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সানফ্লাওয়ার ও পাম তেলের বিকল্প তেল হিসাবে সয়াবিনের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। লাতিন আমেরিকায় খরার কারণে সয়াবিন তেলের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।

পাশাপাশি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহণ ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে পামতেলের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন অপরিশোধিত সয়াবিন ২ হাজার মার্কিন ডলার ও পাম অয়েল এক হাজার ৯৫০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। মূলত এসব কারণে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে।

Oil prices have risen in the international market:It has also affected Bangladesh:Nationwide stockpile godown raids

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ অনুযায়ী গত পাঁচ মে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ভোজ্যতেলের দাম নতুন করে নির্ধারণ করে। সেই নির্ধারণ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন এক হাজার ৭৯০ ডলার ও প্রতি টন পাম তেল এক হাজার ৭৫০ ডলার ভিত্তি মূল্য ধরে দেশের খুচরা বাজারে প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন ১৮০ টাকা, বোতল সয়াবিন ১৯৮ টাকা ও পাঁচ লিটারের বোতল সয়াবিন ৯৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি প্রতিলিটার খোলা পাম অয়েল ১৭২ টাকা দরে নির্ধারণ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য রেপসিড অয়েল/ক্যানোলা ও সানফ্লাওয়ার অয়েলের শুল্ক কমানোর জন্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শুল্ক কমানো হলে বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের বিকল্প হিসাবে বাজারে সরবরাহ বাড়বে।

লোভী মানসিকতা কৃত্রিম সংকট তৈরির মূল কারনঃ

ক্রাইম ডায়রির নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সারদেশে এখনও পর্যাপ্ত তেলের সরবরাহ আছে। মিল থেকেও সরবরাহে কোন কার্পন্য করা হচ্ছে না।  কিন্তু দাম বৃদ্ধির তথ্যের ওপর ভিত্তি করে খুচরা বিক্রেতা ও পাইকারি ডিলাররা বেশি মুনাফার লোভে তেল মজুত করার কারনে পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যেন বাজারে কোন তেলই নেই।  ক্রেতারা পণ্যটি কিনতে গিয়ে খালি হাতে ফিরছে এমন দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় ।

পরিস্থিতির চাইতে প্রচারও অনেক ক্ষেত্রে বেশী হয়। আর কিছু দোকানে পাওয়া গেলেও উচ্চ মূল্য দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।  শুধু ব্যবসায়ীরাই মজুদ করছেন এমনও নয়। মজুদ করছেন গৃহকর্তারাও ফলে সাধারন মানুষ বাজারে গিয়ে তেল পাননা। করোনার সময় ও এমন হয়েছেল । কিছু মানুষের মানসিকতাই এমন পরে যদি না পাওয়া যায় আগেভাগেই কিনে কিনে ঘর বোঝাই করে রাখে। ফলে বাজারে সাময়িক কৃত্রিম সংকট তৈরি হয় আর এর মাশুল গুনতে হয় সাধারন মানুষকে।

সারাদেশে চলছে অভিযানঃ

 মাঠে আছে  জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং র‌্যাব ও পুলিশ। তাছাড়া বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসন এবং থানা গুলোতে উপজেলা প্রশাসনও যথেষ্ট তৎপর হওয়ায় তেল বের হতে শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজশাহী,ঢাকা  চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খুচরা ও পাইকারি ডিলারের অবৈধভাবে মজুত করা তেল  উদ্ধার করা হয়েছে। জরিমানার পাশাপাশি শাস্তিমুলক ব্যবস্থাও গ্রহন করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে তেল দৃশ্যমান হতে শুরু করে। পাশাপাশি মিল  থেকে নতুন দামের তেল বাজারে ছাড়া হলে সরবরাহ আরও বাড়ে। তবে সরবরাহ বাড়লেও বাজারের চাহিদার এখনও যথেষ্ট ঘাটতি দৃশ্যমান।

বাংলাদেশে এখন প্রতি লিটার বোতলজাত ভোজ্যতেলের মূল্য ১৯৮ টাকা, একই সময়ে ভারতে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২২৪.৬৫ টাকা, পাকিস্তানে প্রায় ২৩৮.৬৯ টাকা এবং নেপালে প্রায় ২১৪.৭৫ টাকা।

অভিযান চলছে রাজধানীতেঃ

রাজধানী হলো সারাদেশের প্রাণ। এখানে অবৈধ মজুত করা তেল উদ্ধারে যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও র‌্যাব-৩।  অভিযানে সরাসরি উপস্থিত থাকছেন ভোক্তা অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান মো. আব্দুল জব্বার মন্ডল এবং ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. মাগফুর রহমান। এসময় রাজধানীর ডেমরার কাজলা ব্রিজ এলাকার মেসার্স অদ্বিতি ট্রেডিং, মেসার্স সিফাত ট্রেডিং এবং মেসার্স মিন্টু স্টোর থেকে পুরোনো রেটের সর্বমোট ২৯ হাজার ৫৮০ লিটার খোলা পাম ও সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়। ক্রয়-বিক্রয়ে পাকা রসিদ সংরক্ষণ না করা, নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে (পুরোনো রেটের সয়াবিন ১৪৩ টাকার পরিবর্তে ১৮৩ থেকে ১৮৪ টাকা) খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি করা ইত্যাদি অপরাধে ৫০ হাজার টাকা করে ৩ প্রতিষ্ঠানকে সর্বমোট ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ সময় উদ্ধারকৃত তেল সরকারি রেটে বিক্রির নির্দেশ প্রদান করেন প্রশাসন।

রাজশাহী বিভাগে তেল উদ্ধারঃ

টিম ক্রাইম ডায়রির রাজশাহী অঞ্চল জানায়, রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর বাজারের একটি গুদাম থেকে ২০ হাজার ৪০০ লিটার ভোজ্যতেল জব্দ করে রাজশাহী জেলা পুলিশের একটি দল।  সোমবার রাত ৮টার দিকে তাহেরপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাজারপাড়া গোডাউন মোড়ে এ অভিযান চালিয়ে গুদামের মালিক বাগমারার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের চৌখালী গ্রামের শহিদুল ইসলাম স্বপনকে আটক করা হয়েছে।

রাজশাহী জেলা পুলিশ সুত্রে জানা গেছে, অভিযানে রাজশাহী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অলক বিশ্বাস, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতেখায়ের আলম ও বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাক আহমেদ অংশ নেন। জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতেখায়ের আলম জানান, গুদামে ১০০ ব্যারেল তেল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কিছু সরিষার তেল আছে। বাকিগুলো সয়াবিন তেল। অসৎ উদ্দেশ্যে তেল মজুত করে রাখায় গুদামের মালিক শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বাগমারা থানায় একটি মামলা করা হবে বলেও জানান পুলিশ কর্মকর্তা ইফতেখায়ের আলম।

বানিজ্যনগরী চট্টগ্রামেও আন্ডারগ্রাউন্ড গুদামে পাওয়া গেছে মজুদ তেলঃ

ক্রাইম ডায়রি চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান হোসেন মিন্টু জানান,  তেল উধাও হয়ে গেলেও আন্ডারগ্রাউন্ডে ও গুদামে মিলছে হাজার হাজার লিটার ভোজ্যতেল। কিছু অসাধু বিক্রেতারা তেল মজুত করে রেখেছে। বাস্তবে এমন চিত্রও মিলেছে চট্টগ্রামে গত কয়েক দিনে প্রশাসনের অভিযানে। গত সোমবার মহানগরীর পাহাড়তলী বাজার থেকে অবৈধভাবে মজুত করে রাখা ১৫ হাজার লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল উদ্ধার করেছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের কর্মকর্তারা।

এদিন দুপুরে বাজারের বিল্লি লেইনে সিরাজ সওদাগরের দোকান ও তিনটি গুদামে অভিযান চালিয়ে এসব সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভোক্তা অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ। অবৈধভাবে তেল মজুত করার দায়ে ওই ব্যবসায়ীকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ নিয়ে গত দুদিনে চট্টগ্রামে বাজারে বিক্রি না করে লুকিয়ে রাখা  প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করেছে প্রশাসন। জানা গেছে, অভিযানের পর হতে তেলের সরবরাহ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।

ক্রাইম ডায়রি// ক্রাইম/অর্থ