সয়াবিন তেলে দেড়মাসে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ

এতে  দেড় মাসে ভোক্তার পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে গড়ে অতিরিক্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই  মিলার ও পাইকারদের পকেটে বাকী কিছু অংশ গেছে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। 

সয়াবিন তেলে দেড়মাসে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৮ টাকা, খোলা সয়াবিন ১৪৩ টাকা ধরা হয়। এ সময় বলা হয়-এ নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেউ যদি বেশি দরে বিক্রি করে তাহলে আইনের আওতায় আনা হবে।  কিন্তু এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম আরও বাড়লে ব্যবসায়ীরা এর দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করলে মন্ত্রণালয় তা নাকচ করে দেয়।
শাহাদাত হোসেন রিটনঃ

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে তেলের দাম বাড়বে এমন গুজব তুলে সয়াবিন তেলের মাত্রাতিরিক্ত দাম বাড়িয়েছে মজুতদাররা। তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে তারা পর্যায়ক্রমে দাম বাড়িয়েছে। এতে  দেড় মাসে ভোক্তার পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে গড়ে অতিরিক্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই  মিলার ও পাইকারদের পকেটে বাকী কিছু অংশ গেছে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। 

সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করা এই ঘটনায় ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত দরের তুলনায় কত বেশি অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর আগে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান এক বৈঠকে বলেছিলেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের কাছ থেকে ১৫ দিনে ১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। 

বিশেষ সুত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম জানুয়ারিতে ছিল প্রতি টন ১ হাজার ৩০০ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮৬০ ডলার। এর প্রভাবে স্থানীয় বাজারেও তেলের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৬ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।

বৈঠক শেষে বিশ্ব বাজারের মূল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। এই দর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে বর্তমান পর্যন্ত কার্যকর আছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৮ টাকা, খোলা সয়াবিন ১৪৩ টাকা ধরা হয়। এ সময় বলা হয়-এ নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেউ যদি বেশি দরে বিক্রি করে তাহলে আইনের আওতায় আনা হবে।  কিন্তু এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম আরও বাড়লে ব্যবসায়ীরা এর দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করলে মন্ত্রণালয় তা নাকচ করে দেয়।

বাজারে সয়াবিনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াতে থাকে মিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।  অনুসন্ধান করে  দেখা যায়, ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সকারের বেঁধে দেওয়া দামে তেল বিক্রির কথা থাকলেও বাজারে বিক্রি হয়েছে বাড়তি দরে। এ দিন রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। যা নির্ধারিত দরের চেয়ে ৭ টাকা বেশি। বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন বিক্রি হয় ১৭০ টাকা। যা নির্ধারিত দামের চেয়ে ২ টাকা বেশি। গড়ে প্রতি লিটারে বেশি দাম নিয়েছে সাড়ে ৪ টাকা।

হিসাব অনুযায়ী, ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি ৪ দিন এই দামে সয়াবিন বিক্রি হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে সয়াবিনের চাহিদা ৫০ হাজার টন। কেজি হিসাবে ৫ কোটি কেজি। এ হিসাবে প্রতিদিন ভোক্তার কাছ থেকে বেশি নেওয়া হয়েছে ২২ কোটি টাকা। ৪ দিনে বেশি নেওয়া হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকা।  ১১ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি এই ৭ দিন খোলা সয়াবিন বিক্রি হয় ১৫৫ টাকা ও বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হয় ১৭০ টাকা দরে। ওই সময়ে গড়ে নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি লিটারে ৭ টাকা বেশি নেওয়া হয়েছে। এ হিসাবে ১ দিনে বেশি নেওয়া হয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। ৭ দিনে বেশি নেওয়া হয়েছে ২৪৫ কোটি টাকা। 

১৮ থেকে ২৪ ফেব্রয়ারি এই ৭ দিন খোলা সয়াবিন ১৬৫ টাকা ও বোতল ১৭০ টাকা করে বিক্রি হয়। ওই সময়ে প্রতি লিটারে গড়ে বেশি নেওয়া হয়েছে ১২ টাকা করে। এ হিসাবে প্রতিদিন বেশি নেওয়া হয়েছে ৬০ কোটি টাকা। ৭ দিনে নেওয়া হয়েছে ৪২৫ কোটি টাকা।  ২৫ ফেব্রুয়ারি থেক ২ মার্চ এ ৬ দিন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৮ ও বোতলজাত ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়। ওই সময়ে প্রতি লিটারে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে ১২ টাকা করে। এ হিসাবে এক দিনে বেশি নেওয়া হয়েছে ৬০ কোটি টাকা। ৬ দিনে বেশি নেওয়া হয়েছে ৩৬০ কোটি টাকা। 

৩ থেকে ১৩ মার্চ এই ১১ দিন প্রতি লিটার তেল বিক্রি হয় গড়ে ২০০ টাকা করে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি লিটারে বেশি নেওয়া হয়েছে ৩২ টাকা। এ হিসাবে প্রতিদিন বেশি নেওয়া হয়েছে ১৬০ কোটি টাকা। ১১ দিনে বাড়তি নেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ এই ৪৫ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে সয়াবিন তেলের সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি লোপাট করা হয়েছে ২ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে ভোক্তার পকেট থেকে। 

এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে ১৪ সংস্থার একটি অভিযান টিম গঠন করা হয়। তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিদপ্তর নিয়মিত মিল পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে। অনিয়ম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি প্রদান করছে।

সোমবার উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে সয়াবিন তেলের ওপর ২০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

আর আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের গুজবে ভোজ্যতেল রিফাইনারি ও পাইকাররা সুবিধা নিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে মঙ্গলবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এনবিআর থেকে ভোজ্যতেল আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি বলে জানা গেছে।

ক্রাইম ডায়রি//অর্থবানিজ্য