প্রদীপ-লিয়াকতের ফাঁসির রায়ঃ ছয়জনের যাবজ্জীবন

আদালত প্রাঙ্গণে অব্স্থান নেয়া নির্যাতিত শত শত পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিই ওসি প্রদীপের কুকর্মের বাস্তবতা বুঝিয়ে দেয়। বাংলাদেশ পুলিশ এ দেশের গর্বিত বাহিনী। কারো ব্যক্তিগত অন্যায়ে দেশের মানুষের অতিআপনজন পুলিশ বাহিনীর সম্মান কখনও ম্লান হবেনা।

প্রদীপ-লিয়াকতের ফাঁসির রায়ঃ ছয়জনের যাবজ্জীবন

আদালতের রায়ে বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার নীতি প্রতিফলিত হয়েছে। জাতী দেখতে পেয়েছে অন্যায় করে কেউ পার পাবেনা। দাপুটে নীতিভ্রষ্ঠরা এই রায়ের মাধ্যমে শুধরানোর ইঙ্গিত পেয়েছে। নচেৎ সবাইকে স্ব স্ব অন্যায় কর্ম প্রমানিত হলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে

হোসেন মিন্টু, চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যুরোঃ

সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে সাবেক ওসি প্রদীপ ও তার সাগরেদ সাবেক এসআই লিয়াকতের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। নানান কল্পনার মাধ্যমে চায়ের দোকানে ঝড় উঠেছিল মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু বিজ্ঞ আদালতের রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

 আদালত প্রাঙ্গণে অব্স্থান নেয়া নির্যাতিত শত শত পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিই ওসি প্রদীপের কুকর্মের বাস্তবতা বুঝিয়ে দেয়।

মজলুমের আত্নচিৎকার ‘খুনি প্রদীপের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’, ‘মেজর সিনহার খুনি প্রদীপের ফাঁসি চাই’, ‘২০০ মানুষ হত্যাকারীর প্রদীপের ফাঁসি চাই ‘ইত্যাদি বলে দেয়া স্লোগানে আদালত চত্তর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

আদালতের রায়ে বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার নীতি প্রতিফলিত হয়েছে। জাতী দেখতে পেয়েছে অন্যায় করে কেউ পার পাবেনা। দাপুটে নীতিভ্রষ্ঠরা এই রায়ের মাধ্যমে শুধরানোর ইঙ্গিত পেয়েছে। নচেৎ সবাইকে স্ব স্ব অন্যায় কর্ম প্রমানিত হলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। 

কক্সবাজারের বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল জানুয়ারী ৩১,২০২২ইং সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন। এতে এপিবিএন’র তিন সদস্যসহ ৭জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে ৬জনকে। 

বেলা ২টার দিকে এই মামলার ১৫ আসামিকে কঠোর নিরাপত্তা দিয়ে আদালত চত্বরে আনা হয়। বেলা ২টা ২৫ মিনিটে এজলাসে এসে আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর মামলা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করেন বিজ্ঞ বিচারক। প্রসঙ্গত অপরাধের পর্যবেক্ষণ বয়ান শুরু করেন । সাক্ষ্য প্রমাণে কার কী অপরাধ দাঁড়িয়েছে সেসব তুলে ধরার পর হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অপরাধ অনুসারে সাজা ঘোষণাকালে প্রধান দুই অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের  বলেন, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত সৃষ্টির ৩৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম এত দ্রুত কোনো হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। এ মামলায় ৮৩ সাক্ষীর মাঝে ৬৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এর আগে হত্যা কিংবা ফৌজদারি কোনো মামলায় এত বিপুলসংখ্যক সাক্ষী নেওয়ার নজির নেই। তেমন নজির নেই এত স্বল্পসময়ে চার্জগঠন, শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনেরও। মাত্র ৩৩ কার্যদিবসে আমরা এ মামলার সব বিচারিক কার্যক্রম শেষ করতে সক্ষম হয়েছি।

কক্সবাজারের বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল জানুয়ারী ৩১,২০২২ইং সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন। এতে এপিবিএন’র তিন সদস্যসহ ৭জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে ৬জনকে

 

তিনি বলেন, আমরা সিনহা হত্যার বিষয়টি প্রমাণে সক্ষম হয়েছি। আমাদের আশা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবেন বরখাস্ত ওসি প্রদীপ ও অভিযুক্তরা। স্বল্পসময়ে সিনহা হত্যার রায় দেশে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

উল্লেখ্য যে, সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ থানার ওসি থাকাকালে মাদক নির্মূলের নামে ২২ মাসে ১৪৪টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার জন্ম দেন। তাতে মারা গেছেন ২০৪ জন। এসব ঘটনাকে দেওয়া হয়েছে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের তকমা। অথচ সাধারণ মানুষ বলছেন, ক্রসফায়ারে নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন নিরীহ।

এমনই একটি সাজানো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি এবং রামু থানায় একটি মামলা করে। সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে এসব মামলা করা হয়। টেকনাফ থানায় করা দুই মামলায় নিহত সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। আর রামু থানায় মাদক আইনে করা মামলাটিতে আসামি করা হয় নিহত সিনহার অপর সফরসঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে।

২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে।

মামলার অন্য আসামিরা হলো— টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, উপপরির্দশক (এসআই) টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা।

মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করার পর আদালত তদন্তভার দেন র‌্যাবকে। একই সঙ্গে পুলিশের করা মামলা তিনটিও র‌্যাবকে তদন্ত করার আদেশ দেন আদালত। এরপর, ২০২০ সালের ৬ আগস্ট সকালে মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করে তদন্তের জন্য র‌্যাবকে হস্তান্তর করা হয়।

এরপর পালানো সম্ভব নয় বুঝতে পেরে অভিযুক্ত ৯ জনের মধ্যে ৭ পুলিশ সদস্যই আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

সেসময় র‌্যাবকে মামলার ভার দেয়ার পর  ২০২০ সালের ১১ আগস্ট পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনসহ সাতদিন পর ১৮ আগষ্ট এপিবিএনের তিন সদস্যকেও গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। তিন সদস্য হলেন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহজাহান মিয়া, কনস্টেবল মো. রাজীব ও কনস্টেবল মো. আব্দুল্লাহকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। সবাইকেই আদালতের অনুমতিক্রমে 

২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে গ্রেফতার  করে আদালতে সোপর্দ করে র‌্যাব। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে ওই দিনই রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা

কারাগারে থাকা এই ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এদের মধ্যে প্রদীপ কুমার দাশ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র‌্যাব-১৩ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে থাকলেও টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক ছিল। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে। একই দিন পুলিশের করা মামলা তিনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। সেই সঙ্গে পুলিশের করা তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা থেকে সাইদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথকে অব্যাহতি প্রদান করেন আদালত।

এর পর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহের আদালত থেকে মামলাটির কার্যক্রম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের আদালতে স্থানান্তর করা হয়। ২০২১ সালের ২৪ জুন পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত ওই দিনই তাকে কারাগারে প্রেরণ করার আদেশ দেন।

২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরুর আদেশ দেন। সেই সঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৬-২৮ জুলাই পর্যন্ত দিন ধার্য করেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় ধার্য দিনগুলোতে সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়নি।

পরে ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। এর মধ্যে প্রথম দফায় ২৩-২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনে দুজনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। দ্বিতীয় দফায় ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয় চারজনের। তৃতীয় দফায় ২০ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয় আটজনের।

চতুর্থ দফায় ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর দুদিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা করা হয় ছয়জনকে। পঞ্চম দফায় ১০-১২ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনে ১৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। ষষ্ঠ দফায় ২৫ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত তিনদিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয় ২৪ জনের। সপ্তম দফায় ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ ছয়জন সাক্ষ্য দেন। এদের মধ্যে পাঁচজনের জেরা সম্পন্ন হলেও তদন্ত কর্মকর্তার জেরা অসম্পন্ন ছিল।

সর্বশেষ অষ্টম দফায় ২৯ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার জেরা সম্পন্ন হয়।

এর পর ৬ ও ৭ ডিসেম্বর আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। সবশেষ ৯-১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলায় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের শেষ দিনে আজ আদালত মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।

এ ছাড়া মেজর সিনহা নিহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি তদন্ত শেষে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। তবে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে কী উল্লেখ ছিল তা জানা যায়নি।

একই ইস্যুতে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারসহ একযোগে দেড় সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যকে অন্যত্র বদলি করে তাদের জায়গায় নতুন পুলিশ সদস্যদের পদায়ন করা হয়। মোটকথা, পুরো পুলিশ বাহিনীর আন্তরিকতা,  বিজ্ঞ আদালতের ন্যায় বিচার ও সরকারের নির্দেশনায় অতি দ্রুততম সময়ে  এই রায় ঘোষণা হওয়ায় সামরিক বাহিনিসহ দেশের আপামর জনতা মনে হাসি ফুটেছে।  অন্যায়ের বিপরীতে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন। 

ক্রাইম ডায়রি // আদালত