সিলেটে মায়ের আহাজারি স্রষ্টার নিকটঃ রাতভর নির্যাতনের অভিযোগ

In Sylhet, mother Ahazari complained to the creator about being tortured overnight

সিলেটে মায়ের আহাজারি স্রষ্টার নিকটঃ রাতভর নির্যাতনের অভিযোগ

সিলেট সংবাদদাতাঃ 

সিলেট মহানগরীর বন্দর বাজার ফাঁড়িতে পুলিশী নির্যাতনে রায়হান আহমদ (৩০) নামের এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় সিলেটের সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়েছে । নির্মম এই ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মিছিল-সমাবেশ করছে স্থানীয় জনগন। রায়হান হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী একই থানায় মামলা দায়ের করেছেন।

অভিযোগের ভিত্তিতে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কতৃপক্ষ । এছাড়া প্রত্যাহার করা হয়েছে আরো তিন পুলিশ সদস্যকে। সোমবার বিকেলে মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নিহত রায়হান আহমদ সিলেট নগরীর আখালিয়ার নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। তার তিন মাসের এক মেয়ে রয়েছে। নগরীর রিকাবিবাজার স্টেডিয়াম মার্কেটে এক চিকিৎসকের চেম্বারে কাজ করতেন বলে এলাকাবাসী ও পরিবার সুত্রে জানা গেছে। 

ঘটনা সুত্রে  প্রকাশ, ১১ই অক্টোবর,২০২০ইং রোববার সকাল সাড়ে ৬টার  দিকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রায়হান উদ্দিন (৩০) নামের এক যুবককে গুরুতর আহতাবস্থায় ভর্তি করেন বন্দরবাজার ফাঁড়ির এএসআই আশেক এলাহী। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭টা ৫০ মিনিটে রায়হান হাসপাতালে মারা যান। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে শক্ত আঘাতের চিহ্ন এবং হাতের নখ উপড়ানো ছিল।

এদিকে পুলিশ দাবী করেছে রায়হান ছিনতাইকারী ছিল। কাঠগড় এলাকায় ছিনতাই করতে গিয়ে গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তার পরিবার পুলিশের অভিযোগ অস্বীকার করে ফাঁড়িতে আটকে রেখে নির্যাতনে হত্যার অভিযোগ তুলেন। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মামলা সুত্রে জানা গেছে, রোববার দিবাগত রাতে নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তন্নি বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় তার স্বামীকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে আটকে রেখে ১০ হাজার টাকা দাবি ও দাবিকৃত টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলার অভিযোগ করেন তিনি। জাতীয় দৈনিকের সংবাদেও এমনটিই এসেছে। এজাহারে ৩০২/৩৪ ধারায় করা মামলার অভিযোগ করা হয়েছে। ক, বা কারা রায়হানকে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে হত্যা করেছেন। এজাহারে রায়হান বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে যে মোবাইল নম্বর দিয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, সেই নম্বরটিও উল্লেখ করা হয়েছে।রায়হানের স্ত্রী  এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ‘প্রতিদিনের মতো গত শনিবার (১০ অক্টোবর) বিকাল ৩টার দিকে তার স্বামী রায়হান আহমদ নিজ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটস্থ ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. কান্তা রাণীর চেম্বারে যান। পরদিন (১১ অক্টোবর) ভোর ৪টা ৩৩ মিনিটে ০১৭৮....১১১১ মোবাইল নাম্বার থেকে শাশুড়ি (রায়হানের মা সালমা বেগম)-এর ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার (০১৭৮.....৯৪৯)-এ কল দিলে সেটি রিসিভ করেন রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ।

এসময় রায়হান আর্তনাদ করে বলেন, তিনি বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাকে বাঁচাতে দ্রুত টাকা নিয়ে বন্দর ফাঁড়িতে যেতে বলেন রায়হান। এ কথা শুনে রায়হানের চাচা ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে রায়হান কোথায় জানতে চাইলে দায়িত্বরত একজন পুলিশ বলেন, সে ঘুমিয়ে গেছে।

আর যে পুলিশ রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন তিনিও চলে গেছেন। এসময় হাবিবুল্লাহকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন ওই পুলিশ। পুলিশের কথামতো হাবিবুল্লাহ আবারো সকাল পৌনে ১০ টার দিকে ফাঁড়িতে গেলে দায়িত্বরত পুলিশ জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সাথে সাথে রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬ টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭ টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা যান। এসময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিলে তারা গিয়ে ওসমানীর মর্গে রায়হানের ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখতে পান।’

তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন।’

মোবাইল নাম্বারটি কনস্টেবল তৌহিদের!
নিহত রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ অভিযোগ করেছেন, রোববার ভোর ৪টার দিকে ০১৭৮...১১১১ মোবাইল নাম্বার থেকে কল দিয়ে তার সাথে কথা বলেন রায়হান। এসময় তিনি কান্নাজিড় কণ্ঠে টাকা নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আসার জন্য চাচাকে অনুনয় করেন। হাবিবুল্লাহকে কল দেয়া মোবাইল নাম্বারটি কার তা নিশ্চিত করতে পারেনি সিলেট মহানগর পুলিশ। তবে, মোবাইল নাম্বার শনাক্তকরণ এ্যাপস ‘ট্রু কলার’-এর মাধ্যমে দেখা গেছে, ০১৭৮....১১১ নাম্বারটি তৌহিদ নামে কোনো এক ব্যক্তির।

একটি সূত্রে জানা গেছে, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তৌহিদ নামে একজন পুলিশ কনস্টেবল কর্মরত আছেন। তবে, পুলিশের পক্ষ থেকে এরকম তথ্য নিশ্চিত করা হয়নি। এই নাম্বারটি কার তা খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ।

গণপিটুনির প্রমাণ নেই সিসিটিভি ফুটেজে।
রায়হানকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে পুলিশ দাবি করলেও সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন) ফুটেজে এর প্রমাণ নেই। পুলিশের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে রোববার (১১ অক্টোবর) ভোরে রায়হানকে নগরের কাষ্টঘরে ছিনতাইকালে গণপিটুনি দেয়ার পর গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির পর তার মৃত্যু হয়।

কিন্তু রায়হানের পরিবার তা মানেননি।। তাদের অভিযোগ,পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে  নির্যাতন করেছে ফলে রায়হানের মুত্যু হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে , নিহতের হাতের নখ টেনে তোলার চেষ্টা করা হয়। তার হাতের মধ্যে সেলাই করা রয়েছে। হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাতেই বোঝা যায় তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।

এদিকে নগরের কাষ্টঘর এলাকায় ওইদিন সকালে কোনো ছিনতাইয়ের গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি বলেও জানান স্থানীয়রা। ওই এলাকার সিসিটিভি ফুটেজে গণপিটুনির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেও জানিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনিম। 

তিনি সাংবাদিকদের  বলেন, এই এলাকার প্রায় পুরো অংশ জুড়েই সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাধীন। এসব ক্যামেরার মনিটর রয়েছে তার কার্যালয়ে। শনিবার (১০ অক্টোবর) রাত ১২টা থেকে রোববার সকাল ৭টা পর্যন্ত কাঠগড় এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। এসব ফুটেজে কোনো গণপিটুনির ঘটনা দেখা যায়নি। এমনকি এই সময়ে কাঠগড় এলাকায় পুলিশের কোনো টহলও দেখা যায়নি। রোববার রাতে মুনিমের কার্যালয়ে গিয়ে এ তথ্য নিশ্চিত হয়েছেন জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি সহ গণমাধ্যম কর্মীরা। কাউন্সিলর মুনিম সাংবাদিকদের  বলেন, শনিবার রাত থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত আমি সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি। ওই এলাকার ফুটেজে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে তিনি জানতে পেরেছেন, এ ধরনের কোন কিছুই ঘটেনি।

এদিকে ছেলে হত্যার বিচার চাইলেন রায়হানের মা। ১২ই অক্টোবর,২০২০ইং সোমবার বিকেল ৩টার দিকে রায়হান হত্যার প্রতিবাদে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের আখালিয়া এলাকায় মানববন্ধন ও টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন স্থানীয় অধিবাসীরা। এ সময় কাঁদতে কাঁদতে এসে রাস্তায় বসে পড়েন রায়হানের মা। তিনি ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে আকাশপানে দুহাত তুলে মহান স্রষ্টার নিকট বিচার চান। মায়ের আত্ন চিৎকারে  ভারী হয়ে উঠে আকাশ বাতাস। জড়ো হওয়া জনতার চোখ ছিল ছলছল। একটি জাতীয় দৈনিকের  সংবাদেও এমনটিই  এসেছে। তার মা , গনমানুষকে বলেন, আমার ছেলে ছিনতাইকারী বা অপরাধী নয় । তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে বিনা দোষে রাতভর নির্যাতন করে হত্যা করেছে । পুলিশ মানুষের রক্ষক, কিন্তু সেই পুলিশই আজ আমার ছেলেকে হত্যা করলো। ঘুষের টাকার জন্য পুলিশ আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। রায়হানের দুই মাস ২১ দিনের একটিমাত্র কন্যাসন্তান রয়েছে। সে বড় হলে তাকে আমি কী সান্তনা দিবো, আর আমি কীভাবে এটি সহ্য করবে?? এমন ঘটনায় অবাক স্থানীয় জনসাাধারণ। তারা এখন নিজেদের নিরাপত্তা  নিয়েও শঙ্কিত। তবে প্রকৃত ঘটনা কি তা জানতে তদন্ত পর্যন্ত মন্তব্য করা ঠিক নয় বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষ নাগরিকেরা।

ক্রাইম  ডায়রি // ক্রাইম // জেলা