যেভাবে গ্রামেগঞ্জে বিস্তার করেছে প্রতারক প্রতিষ্ঠান এমটিএফই

উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম মডেলে ব্যবসা করত প্রতিষ্ঠানটি। যেভাবে দেশেও ব্যবসা করছে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান।

যেভাবে গ্রামেগঞ্জে বিস্তার করেছে  প্রতারক প্রতিষ্ঠান  এমটিএফই
ছবি- অনলাইন হতে সংগৃহীত

উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম মডেলে ব্যবসা করত প্রতিষ্ঠানটি। এখানে বিনিয়োগকারীদের একটি অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। বিনিয়োগকারী যার মাধ্যমে বিনিয়োগ করবেন তিনিও এর কমিশন পাবেন।

ক্রাইম ডায়রি অনলাইন ডেস্কঃ

রাতারাতি ধনী হওয়ার ফাঁদে পা দিয়ে এমটিএফই নামে একটি বিদেশি অ্যাপে বিনিয়োগ করে কুমিল্লার শত শত মানুষ এখন হাহাকার করছেন। প্রতারিত হওয়ার পর তারা না পাচ্ছেন তথাকথিত টিম লিডারদের দেখা; না পারছেন এ ব্যাপারে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে।ঠিক কত মানুষ এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই কারও কাছে। তবে বোঝা যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই যুবক। গোটা জেলাতেই বিছানো ছিল এই চক্রের জাল। 

এমটিএফই অ্যাপে যারা বিনিয়োগে উৎসাহিত করেছেন সেসব ‘টিম লিডারদের’ প্রায় সবাই মুরাদপুর উপজেলার বাসিন্দা। ধারণা করা হচ্ছে, ওই উপজেলাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রতারিত হয়েছেন।  

যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছেন, তারা এমন বিষয় শুনেছেন। কিন্তু কেউ তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেননি।অপরদিকে ‘টিম লিডাররা’ বলছেন, ব্যবসায় লাভ-লোকসান আছেই; যারা বিনিয়োগ করেছেন, তারা ‘বুঝেশুনেই’ বিনিয়োগ করেছেন।  প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা জানান, মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ-এমটিএফই হচ্ছে দুবাইভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম মডেলে ব্যবসা করত প্রতিষ্ঠানটি। এখানে বিনিয়োগকারীদের একটি অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। বিনিয়োগকারী যার মাধ্যমে বিনিয়োগ করবেন তিনিও এর কমিশন পাবেন। কারও অধীনে ১০০ বিনিয়োগকারী থাকলে তিনি ‘সিইও’ হিসেবে গণ্য হবেন। মূলত ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (যেমন বিটকয়েন) বিনিয়োগ করতে হয়। যদিও ক্রিপ্টো ট্রেডিং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।

বিনিয়োগকারী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টিম লিডাররা বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে শুরুতে গ্রাহকদের তিন হাজার টাকায় এমটিএফই প্ল্যাটফর্মে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দিত। প্রতিটি অ্যাকাউন্টে ‘রেফার’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে টিম লিডারের হিসাব বা আইডি নম্বর। পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগকারীরা এই অ্যাপে ডলার জমা করতেন।

বলা হত, এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন দুই হাজার টাকা করে লাভ পাওয়া যাবে। এই ফাঁদে পড়েই অনেকে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু সম্প্রতি বিনিয়োগকারীরা টাকা তুলতে পারছিলেন না, তখন বলা হয় সফটওয়্যার আপডেটের কথা। হঠাৎ করেই বিনিয়োগকারীদের অ্যাপের অ্যাকাউন্টে জমা থাকা ডলারের বিপরীতে সমপরিমাণ দেনা দেখাতে থাকে। তারা নিজেদের অ্যাকাউন্টে ঢুকতে পারছিলেন না। পরে অ্যাপটি উধাও হয়ে যায়। 

কেইস ষ্টাডি-

কুমিল্লা নগরীর টমছম ব্রিজ এলাকার বাসিন্দা মো. মিজানুর রহমান এই অ্যাপ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তাকেসহ কয়েকজনকে এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন কথিত টিম লিডার মুরাদনগরের আহম্মেদ বিন শামীম।তার কথা শুনেই মিজান কুমিল্লায় তাদের একটি সেমিনারে অংশ নেন। সেখানে বলা হয়, লাখ টাকায় প্রতিদিন ২ হাজার টাকা লাভ আসবে, লোকসানের আশঙ্কা নেই। সেখান থেকেই বিনিয়োগে উদ্বুব্ধ হন তিনি। মিজান বলেন, “এই অ্যাপে গত মাসে বিনিয়োগ করেছি ৫ লাখ টাকা। কিন্তু মাস না যেতেই আমার ব্যালেন্স শূন্য হয়ে যায়। আমি এখন নিঃস্ব। টিম লিডারের দেখাও পাচ্ছি না।মিজানের মত তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করে এখন পরিবারের চাপের মধ্যে পড়েছেন আবুল খায়ের নামে আরেক ভুক্তভোগী।

তিনি বলছিলেন, “চলতি বছরের শুরুতে এই অ্যাপের সঙ্গে পরিচিত হই। প্রথমে কিছু টাকা লাভ হয়েছিল। তখন আমরা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করতাম। টিমলিডার মুরাদনগরের গোলাম মাওলা টিটু হোয়টসঅ্যাপ গ্রুপে পরামর্শ দেন অটো ট্রেড করার জন্য।এ পদ্ধতিতে ট্রেড করে কয়েক দিনের মধ্যে আমার ব্যালেন্স শূন্য হয়ে যায়। এখন পরিবারের চাপে আছি। টাকার কোনো হিসাব দিতে পারছি না।”

নগরীর চর্থা এলাকার বাসিন্দা মনির আহমেদ জানান, এই অ্যাপটি যুবসমাজের মধ্যে ঝড় তুলেছিল। টিমলিডার নামধারীরা কুমিল্লা নগরীসহ বিভিন্ন স্থানে মার্কেটে অফিস নিয়েও এই অ্যাপের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। মনিরের ধারণা, যুবকদের ‘ডেসটিনির মত’ ফাঁদে ফেলেছে। তার এলাকার অন্তত ২০ জন যুবক প্রতারণায় পড়ে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা খুইয়েছেন।

কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লায় প্রথমে এই অ্যাপটি পরিচিত করান মুরাদনগরের ধামঘর গ্রামের আহম্মেদ বিন শামীম। পরে শামীম টিমলিডার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন একই উপজেলার গুঞ্জর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে গোলাম মাওলা টিটুকে। পরে শামীম ও টিটু মিলে মুরাদনগর উপজেলার কোম্পানীগঞ্জ কলেজ সুপার মার্কেটে অফিস খুলে এই অ্যাপের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন দীর্ঘদিন।

ধামঘর গ্রামের বাসিন্দা মো. রমজান আলী বলেন, “আমাদেরকে এই অ্যাপের সঙ্গে পরিচয় করায় গ্রামের আহম্মেদ বিন শামীম। তখন তিনি বলেন, এখানে বিনিয়োগ করলে লোকসান হওয়ার আশঙ্কা নেই। এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন দুই হাজার টাকা লাভ থাকবে। তবে প্রতিমাসে একবার লোকসান হবে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। তার কথামত এই অ্যাপে বিনিয়োগ করি কয়েক লাখ টাকা। কিন্তু মাস না যেতেই আমার ব্যালেন্স শূন্য হয়ে যায়। আমি এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না। শামীমকেও এখন খুঁজে পাচ্ছি না। উপজেলার বাঙ্গরা এলাকার বাসিন্দা নাহিদ হাসান বলেন, তার প্রায় ৭ লাখ টাকা গেছে। পরিবারের লোকজন টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। টিমলিডারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।একই অবস্থায় সাইমন সরকারের। তিনি এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে শনিবার অ্যাপটির টিম লিডার মুরাদনগর উপজেলার ধামঘর গ্রামের আহম্মেদ বিন শামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে গত সপ্তাহে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তখন তিনি বলেন, “আমরা কাউকে লাভের নিশ্চয়তা দিয়ে কিংবা লোভ দেখিয়ে এখানে বিনিয়োগে উৎসাহিত করিনি। আমরা অ্যাপ সম্পর্কে তাদের প্রশিক্ষিত করেছি। সবাই যার যার ইচ্ছামত এখানে বিনিয়োগ করেছে এবং লাভও পেয়েছেন।

তিনি বলেন, “আমরা কুমিল্লা শহরে বিভিন্ন সেমিনারের মাধ্যমেও বিনিয়োগকারীদের বুঝিয়েছি। এখন আমাদের কোনো দায়ভার নেই। সবাই বুঝেশুনে বিনিয়োগ করেছেন।” আরেক টিম লিডার গোলাম মাওলা টিটু সাংবাদিকদের বলেন, “আমি তো আর এই অ্যাপের মালিক না। এই অ্যাপের মালিক একটি বিদেশি কোম্পানি। যারা এখানে ইনভেস্ট করেছেন, তারা বুঝেশুনেই করেছেন। সব ব্যবসায় লাভ-লোকসান রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সেটা আমরা আগেই বলেছি।”

মুরাদনগর থানার ওসি কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, “এ রকম কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। যদি কেউ অভিযোগ করে, তাহলে তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ এবং নিষিদ্ধ বলে জানান কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আহমেদ সঞ্জুর মোর্শেদ।

তিনি বলেন, “অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে যুবকরা প্রতারিত হয়েছে, এ রকম কথা শুনলেও এখনও কোনো অভিযোগ পাইনি। যদি কেউ অভিযোগ করে, তাহলে খোঁজ-খবর নিয়ে তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বেরালাক্ষী গ্রামের আনোয়ার হোসেন (আসল নাম গোপন রাখা হচ্ছে) ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে জানতে পারেন, বিদেশী একটি কোম্পানিতে ডলারে বিনিয়োগ করলে প্রতিমাসে ভালো মুনাফা পাওয়া যাবে। ঐ গ্রামের কুয়েত প্রবাসী এক ব্যক্তি প্রথম এই স্কিমের কথা গ্রামের কয়েকজনকে জানান। তার একজন আত্মীয়কে তার প্রতিনিধিও নিযুক্ত করা হয়। প্রতিনিধির মাধ্যমে পরের কয়েক মাসে গ্রামের আড়াই শ’-এর বেশি মানুষ মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) নামের একটি মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) স্কিমের অংশ হন।

আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, ‘ওরা বলছিল যে বিদেশী একটা কোম্পানিতে ডলারে বিনিয়োগ করা হবে। সেখানে যে মুনাফা হবে, তা প্রতিদিন আমাদের হিসাবে যোগ হবে। মোবাইলেই ওই টাকা জমা, লাভ বা লস হলে সব দেখা যাবে। কুয়েতের ওই লোকের আত্মীয়ের মাধ্যমে আমাদের গ্রামের আরো কয়েকজন এমন ইনভেস্ট করে ভালো টাকা পেয়েছে। তা দেখে আমি একটা এনজিও থেকে কিছু টাকা ঋণ করে জমা দেই।’

ফেব্রুয়ারি মাসে ওই স্কিমে ৫০ হাজার টাকা জমা দিয়ে যোগ দেয়ার পর জুলাই মাস পর্যন্ত তিনি টাকা পেয়েছেন। ওই লাভের টাকা পুনরায় এই স্কিমেই বিনিয়োগ করেছেন। তার পরামর্শে তার অনেক আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুদেরও এখানে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছেন। তাদের মধ্যে একজন জমি বিক্রির দু’লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

গ্রামের লোকজনকে বলা হয়েছে, এটা ইসলামি শরীয়ত সম্মত একটা ব্যবসা। এটা টাকা বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হবে। সেখান থেকেই সদস্যদের মুনাফা দেয়া হবে।নিয়মিত মোবাইলে অ্যাপের মাধ্যমে লাভের টাকার হিসাব রাখা হতো। অ্যাপ থেকেই টাকা তোলা যায়। মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে টাকা জমা বা তোলার ব্যবস্থা থাকলেও বেশিরভাগ মানুষ কোম্পানির প্রতিনিধি বা যার মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, তার কাছেই লেনদেন করত।প্রথম প্রথম সবাই প্রতিদিন নিয়মিত মুনাফা পেয়েছে। তাদের বেশিরভাগই ওই টাকা আবার বিনিয়োগ করেছিল।

কিন্তু আগস্ট মাস থেকে তারা কেউ আর টাকা তুলতে পারছে না। প্রথমে তাদের অ্যাকাউন্টে কিছু কিছু করে ডলার জমা দেখানো হলেও পরে সেগুলো মাইনাস দেখাতে শুরু করে।আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, ‘চলতি মাসের শুরুর দিকে দেখা যায় যে কোনো লাভও আসছে না, লোকসানও আসছে না। তখন কোম্পানির লোকজনের সাথে যোগাযোগ করলে বলে যে সার্ভারে সমস্যা। কয়েকদিন পরে ডাবল করে লাভ আসতে শুরু করল, কিন্তু কেউ টাকা তুলতে পারছিল না। আবার কোম্পানির লোকজনের সাথে যোগাযোগ করলে তারা আরেকটু ওয়েট করতে বলে, তাড়াতাড়ি সমাধান হয়ে যাবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘গত দু’দিন আগে সবার অ্যাকাউন্টে হঠাৎ করে লস দেখানো শুরু করে মেসেজ আসা শুরু করছে, আপনি বকেয়া টাকা পরিশোধ করেন। না হলে কোম্পানি আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখন কুয়েতের ওই লোকেরও ফোন অফ আছে। আমাদের এলাকায় অনেকে জমি বিক্রি করে, লোন নিয়ে টাকা জমা দিয়েছিল। এখন তো সবার সর্বহারা অবস্থা।এখন আনোয়ার হোসেনের মাধ্যমে যারা এই স্কিমে অংশ নিয়েছিল, তারা এসে তাকে ধরেছে। পাওনাদারদের ভয়ে তিনি বাড়িতেও থাকতে পারছেন না।

এমটিএফই কোম্পানি সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে?
দুবাই-ভিত্তিক এই কোম্পানির পুরো নাম মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ বা সংক্ষেপে এমটিএফই। ২০২২ সাল থেকে এই কোম্পানি ব্যবসা শুরু করে, যদিও তাদের ওয়েবসাইটে ২০১৫ সাল থেকে ব্যবসা শুরুর দাবি করা হয়েছে।দুবাই-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হলেও ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা হিসেবে ক্যানাডার অন্টারিওর একটি ঠিকানা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওই ঠিকানায় এই প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো অফিস পাওয়া যায়নি। বরং এটা দ্যা ভিঞ্চি ভার্চুয়ালের একটি ভার্চুয়াল অফিস স্পেস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

চলতি বছরের জুলাই মাসে একটি ওয়েবসাইট চালু করা হলেও এটি মূলত প্লে-স্টোর ও অ্যাপস্টোর থেকে অ্যাপ নামিয়ে এদের সদস্য হতে হয়। ওই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশী মাসুদ আল ইসলাম। শুরুতে অন্তত ২৬ ডলার বা সম-পরিমাণের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে ওই টাকা জমা দেয়া যায়।

অ্যাপল স্টোরের অ্যাপে ওই কোম্পানির পরিচিত সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি একটি কম্যুনিটি-ভিত্তিক ট্রেডিং প্লাটফর্ম। যারা বিনিয়োগ করতে চায়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে এমটিএফই। যার মধ্যে আছে বিদেশী মুদ্রা, স্বর্ণ, জ্বালানি তেল, শেয়ার মার্কেটসহ শতাধিক পণ্য। বিনিয়োগকারীরা ওই অ্যাপের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যবসায় স্বল্প পুঁজি আকারে বিনিয়োগ করতে পারবে এবং মুনাফা পাবে।সেখানে দাবি করা হয়েছিল, যে টাকা বিনিয়োগ করা হবে, প্রতিদিন তিন থেকে আট শতাংশ মুনাফা দেয়া হবে। যেমন তাদের প্রথম প্লানে বলা হয়েছে, কেউ যদি ৩০ ডলার বিনিয়োগ করে, তাহলে মাসে ২২ থেকে ৪৪ ডলার পর্যন্ত পেতে পারে।

শরিয়ার নামে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং
যদিও কোম্পানির কোথাও মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা বহু স্তর-ভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকারীদের সংগ্রহ পদ্ধতি মাল্টি লেভেল-ভিত্তিক।আনোয়ার হোসেন জানান, কারো রেফারেন্সে নতুন বিনিয়োগকারী এলে প্রত্যেক নতুন সদস্যের জন্য তিনি দুই ডলার করে পাবেন।তিন বলেন, ‘আমার রেফারেন্সে ১২ জন এসেছিল, তাদের জন্য আমি প্রতিদিন ২৪ ডলার করে পেয়েছি। তেমনি তাদের রেফারেন্সে আরো লোকজন এলে তারাও এভাবে ডলার পাবে। বিনিয়োগ করে যে টাকা পাওয়া যায়, এভাবে লোকজন আনতে পারলে আরো বেশি টাকা আসে।’

প্রথম লেভেলে দু’জনকে আনতে হবে। ওই দুজন আবার দুজন করে সদস্য আনবে। এদের প্রত্যেকে যে টাকা বিনিয়োগ করবে, তার একটা কমিশন পাবেন সদস্য আনা ব্যক্তিরা। নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে এভাবে সদস্য বানাতে পারলে তাদের সিইও হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হতো।


ঠিক একই পদ্ধতিতে বাংলাদেশে আগের জিজিএন, ডেসটিনি, নিউওয়ের মতো কোম্পানিগুলো ব্যবসা করেছে, যার শেষভাগে অসংখ্য মানুষ তাদের অর্থ হারিয়েছে। দেখা গেছে, এমন ব্যবসায় শেষের দিকে যখন অনেক বিনিয়োগকারী সম্পৃক্ত হয়, তারা আসলে প্রতারণার শিকার হয়।স্বল্প জমাকৃত অর্থের বিপরীতে বিপুল মুনাফা দেয়ার লোভ দেখিয়ে মাত্র এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভারত, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বিপুল সদস্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে এমটিএফই। অ্যান্ড্রুয়েড প্লে-স্টোরে এই অ্যাপটি ১০ লাখের বেশি মানুষ ডাউনলোড করেছে।

এটাকে ইসলামি আদলে মুনাফা দেখানোর জন্য সপ্তাহে মোবাইলের অ্যাপে চার দিন মুনাফা যোগ হতো, এক দিন লোকসান দেখানো হতো। আর দু’দিন থাকত ছুটি।অর্থাৎ একজন ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে সপ্তাহে চার দিনে পাঁচ ডলার করে ২০ ডলার পেত। আরেক দিন লোকসান দেখানোয় আবার পাঁচ ডলার কাটা যেত। সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা আসত।যারা বিনিয়োগ করেছে, তাদের বেশিরভাগই এই মুনাফার টাকা পুনরায় আবার বিনিয়োগ করেছিল।

বিনিয়োগের তথ্য কতটা সঠিক?
আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, তাদের গ্রামে এক নারী আট লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। তার একজন সহকর্মী বিনিয়োগ করেছিলেন চার লাখ টাকা। এখন তাদের অ্যাকাউন্টে এক টাকাও নেই।

এমটিএফই ওয়েবসাইট বা অ্যাপে বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগের দাবি করা হলেও ওই কোম্পানি বিশ্বের কোথায়, কোন ব্যবসায় বা কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে, তার কোনো তথ্য কোথাও উল্লেখ নেই। কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বা বিশ্বের কোনো দেশের সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জে তাদের বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া যায়নি। দুবাই, ভারত বা বাংলাদেশের কোনো স্টক এক্সচেঞ্জেও তাদের বিনিয়োগের তথ্য নেই। ক্যানাডায় ওই কোম্পানির বিনিয়োগ রয়েছে বলে দাবি করা হলেও গত জুলাই মাসে অন্টারিওর সিকিউরিটিজ কমিশন একটি বিবৃতিতে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, সেখানে ওই কোম্পানির নামে ব্যবসা করার কোনো অনুমোদন নেই।

ক্যানাডার ফিনট্রাসে এটি অনুমোদিত বলে বলা হলেও ফিনট্রাস আসলে কোনো রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান নয়। তাদের কাজ মূলত কানাডায় অর্থ পাচার রোধে কাজ করা।বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেছেন, তার জানা মতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার বা ব্যবসা করার কোনোরকম অনুমোদন ওই কোম্পানির নেই।

ইন্টারনেটে তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, বর্তমানে ডিঅ্যাক্টিভেট করে রাখা হলেও এমটিএফইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দাবিদার মো: মাসুদ আল ইসলামের ফেসবুক প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, তিনি এর আগে পিএলসি আলটিমার সদস্য সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। এটি ছিল অ্যালেক্স রেইনহার্ডের প্লাটিনকয়েন নামের আরেকটি এমএলএম ধরনের প্রতিষ্ঠানের উত্তরসূরি প্রতিষ্ঠান।

ওই পিএলসি আলটিমার বাংলাদেশে বেশ কিছু গ্রাহক রয়েছে। বগুড়ার এমন এক গ্রাহকবলেছেন, সেখানে তার চার লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল। এখন আর কোনো টাকাই ফেরত পাচ্ছেন না। লোকলজ্জার ভয়ে ওই ব্যক্তিও তার নাম প্রকাশ করতে চাননি। গত বছরের অক্টোবরে পিএলসি আলটিমা বন্ধ হয়ে যায়।অনেকটা ওই সময়েই এমটিএলই কোম্পানি চালু করেন মাসুদ আল ইসলাম। নিজেকে এমটিএলই কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেন।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে একটি পোস্টে এমটিএফই দাবি করেছে, তারা এখন পর্যন্ত ২০০ বিলিয়ন ডলারের লেনদেন করেছে। দাবি করা হলেও এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ তাদের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি।ডলারে বিনিয়োগের হিসাব-নিবেশ করা হলেও মূলত বিভিন্ন দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকার লেনদেন করা হতো। বাংলাদেশে যেমন সদস্যরা ডলারের সম-পরিমাণে টাকা দিয়েছে। আবার মুনাফা তুলতে হলে ডলারের সম-পরিমাণ হিসাব করে টাকা তোলা হতো। বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করেও এই টাকার লেনদেন করা হতো।

গোপনে কিভাবে কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি?
বাংলাদেশের বহু মানুষ এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলেও গণমাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে মাত্র কয়েক দিন আগে থেকে।মূলত প্রবাসীদের মাধ্যমে এবং গ্রামীণ এলাকায় ব্যবসাটি ছড়িয়ে পড়ায় শহর এলাকা বা গণমাধ্যমে এ নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি।তবে গত সপ্তাহ থেকে দেশের অনেকগুলো জেলা থেকে লোকজনের ক্ষতিগ্রস্তের খবর প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে এ প্রতিষ্ঠানের নাম আলোচনায় উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেছেন, ‘আমরা ২০১৫ সাল থেকে বহুবার, প্রায় প্রতি বছর মানুষজনকে সতর্ক করে আসছি যেন তারা এ ধরনের অতি মুনাফা কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে। বিশেষ করে বিদেশী মুদ্রায় বিনিয়োগ নিয়ে তো আইনই আছে। তারপরেও মানুষ যদি গোপনে এভাবে ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে।তিনি আরো বলেন, ‘এখন তারা ক্ষতির শিকার হয়েছে বলে কথা বলছে, কিন্তু এত দিন তো তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা কারো কাছে কোনো কথাও বলেনি। মানুষ যদি গোপনে গোপনে এমন কর্মকাণ্ড করে আমাদের পক্ষে তো তাদের শনাক্ত করা কঠিন।’

কর্মকর্তারা বলছেন, ডলারে বিনিয়োগের কথা বলা হলেও তারা তো আসলে সম-পরিমাণের টাকায় লেনদেন করেছে। ফলে মোবাইল ব্যাংকিং বা ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করে করা হলে তো ধরার উপায় নেই। তবে হুন্ডির মাধ্যমে বা দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারে জড়িতদের শনাক্ত করা গেলে আইনি ব্যবস্থায় আনার সুযোগ রয়েছে। মেজবাউল হক বলেন, ‘এখন বিষয়টি নজরে আসার পরে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করতে শুরু করেছে।’
ক্রাইম ডায়রি/ক্রাইম ///সূত্র : বিবিসি