স্বর্ন চোরাচালানের সাতকাহনঃ সর্ষের ভিতরের ভূত তাড়াতে হবে আগে

সহজে ও স্বল্প খরচে আমদানির সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও বৈধ পথে খুব বেশি স্বর্ণ আমদানি হচ্ছে না। বরং ব্যাগেজ রুলসের সুবিধা নিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ দেশে প্রবেশ করছে। আর এই সুযোগ দিয়ে কাড়িকাড়ি টাকা কামাচ্ছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও বিমানের কিছু অসাধু কর্মী। অনেকে এত টাকা কামিয়েছেন যে, দু’চার বছর চাকরী করে চাকরীও ছেড়েছেন। তারা এখন হাজার কোটি টাকার মালিক।

স্বর্ন চোরাচালানের সাতকাহনঃ সর্ষের ভিতরের ভূত তাড়াতে হবে আগে

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সহজে ও স্বল্প খরচে আমদানির সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও বৈধ পথে খুব বেশি স্বর্ণ আমদানি হচ্ছে না। বরং ব্যাগেজ রুলসের সুবিধা নিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ দেশে প্রবেশ করছে। আর এই সুযোগ দিয়ে কাড়িকাড়ি টাকা কামাচ্ছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও বিমানের কিছু অসাধু কর্মী। অনেকে এত টাকা কামিয়েছেন যে ,দু’চার বছর চাকরী করে চাকরীও ছেড়েছেন। তারা এখন হাজার কোটি টাকার মালিক।

বিশেষ সংবাদদাতাঃ

অবৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি ঠেকানোসহ এই খাতে শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে সরকার ২০১৮ সালে নীতিমালা তৈরি করে, যার মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে আমদানির সুযোগ তৈরি হয়। অন্যদিকে ব্যাগেজ রুলসেও কর পরিশোধ করে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ আনার সুযোগ রয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সহজে ও স্বল্প খরচে আমদানির সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও বৈধ পথে খুব বেশি স্বর্ণ আমদানি হচ্ছে না। বরং ব্যাগেজ রুলসের সুবিধা নিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ দেশে প্রবেশ করছে। আর এই সুযোগ দিয়ে কাড়িকাড়ি টাকা কামাচ্ছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও বিমানের কিছু অসাধু কর্মী। অনেকে এত টাকা কামিয়েছেন যে, দু’চার বছর চাকরী করে চাকরীও ছেড়েছেন। তারা এখন হাজার কোটি টাকার মালিক।

হঠাৎ করেই এত বেশি পরিমাণে স্বর্ণ প্রবেশ নিয়ে বিস্মিত শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারাসহ সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ। সবাই মনে করছেন একটা বিষয় যে, সরকারকে শুল্ককর দিলেও এই স্বর্ণের একটি বড় অংশ চোরাচালানকারীদের হাতেই যাচ্ছে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক আমদানির চাইতে ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে স্বর্ণ আনায় খরচ সাশ্রয় ও হয়রানিমুক্ত হওয়ায় জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের অনেকেই কৌশলে এ পথে স্বর্ণ আনছেন।  আইনগতভাবে এ ব্যবস্থা অবৈধ না। তাই  এসব স্বর্ণ আটকানোও যাচ্ছে না। বিমানবন্দরের বাইরে এসে বাহক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ইস্যুটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অবহিত করেছে ঢাকা কাস্টম হাউজ। এসব কারণে বহুল আলোচিত স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় বাজারে শৃঙ্খলা আনার সরকারি উদ্যোগও ভেস্তে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাগেজ রুলসে পরিবর্তন আনার পরামর্শ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের।

বিগত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে ১ হাজার ৩৫৮ কেজি স্বর্ণ, যার দাম প্রায় ৮১৫ কোটি টাকা। কেবল ডিসেম্বরেই ঐ বিমানবন্দর দিয়ে এসেছে আগের তিন মাসের প্রায় সমান (১ হাজার ৩১৩ কেজি) স্বর্ণ। অথচ এর আগের বছরের সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী তিন মাসে ব্যাগেজ রুলসের সুবিধায় আনা স্বর্ণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৬ কেজি। ঢাকা কাস্টম হাউজ সূত্র জানিয়েছে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমেও গত নভেম্বর থেকে চলতি মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত ব্যাগেজ রুলসের আওতায় দেশে প্রবেশ করেছে ১ হাজার ৮৫০ কেজি স্বর্ণ। এসব স্বর্ণের মধ্যে স্বর্ণালংকার তেমন ছিল না। প্রায় সবই স্বর্ণের বার। এনবিআরের শুল্ক বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যেও ইস্যুটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে।

 বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনকারী শুল্ক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, এসব স্বর্ণ সংশ্লিষ্ট যাত্রী কিংবা বৈধ ব্যবহারকারীদের জন্য আসছে না। শুল্ক পরিশোধ করা যাত্রীরা কেবল বাহক হিসেবে কাজ করছেন। প্রত্যেক যাত্রী দুটি স্বর্ণের বার এনে ঘোষণা দিয়ে সরকারকে ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিচ্ছেন।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বরাতে জানা যায়, বিমানবন্দরে আটক হওয়া অবৈধ স্বর্ণের একটি বড় অংশ উদ্ধার হয় বিমানের ভেতর থেকে। বিমানের টয়লেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে স্বর্ণ উদ্ধার হলেও এসব ঘটনায় কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বিমান কর্তৃপক্ষ। এসব ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণসহ বিমানের কর্মীদের আটক করেছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। প্রমাণ মিলেছে এসব চোরাচালানে বিমানের কর্মীদের সম্পৃক্ততার। তাই এবার বিমানের কর্মীদের চোরাচালানের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে ঢাকা কাস্টম হাউজ। কর্মীদের নির্দোষ প্রমাণে ব্যর্থ হলে নিজেই অর্থদণ্ডের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ বিমান। ঢাকা কাস্টম হাউজ সূত্র জানায়, গত বছর ১৭ ডিসেম্বর  ঢাকা কাস্টমস হাউজের কমিশনার লুৎফর রহমান বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে একটি নোটিশ পাঠান। স্বর্ণ চোরাচালানে বিমানের কর্মীরা সম্পৃক্ত রয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা বিমানের একটি ফ্লাইটের টয়লেটসহ বিভিন্ন স্থানের স্ক্রু খুলে ৬২.৩৭ কেজি স্বর্ণ ও ৩৯৭ গ্রাম স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। যাত্রী নামানোর পর বিমানের বিশেষ বিশেষ স্থান থেকে স্বর্ণ উদ্ধার হওয়ায় এই চোরাচালানের সঙ্গে  বাংলাদেশ বিমানের কর্মীরা জড়িত বলে মনে করছে কাস্টম হাউজ।
বিমান কর্তৃপক্ষকে এ ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের নামের তালিকাসহ ১৫ দিনের মধ্যে নোটিশের জবাব  দিতে বলে কাস্টম হাউজ। একই সঙ্গে, যদি বিমান দোষীদের তালিকা দিতে এবং কর্মীদের নির্দোষ প্রমাণে ব্যর্থ হয় তাহলে কেন বাংলাদেশ বিমানের ওপর অর্থদণ্ড আরোপ করা হবে না তারও জবাব দিতে বলা হয় নোটিশে। জবাব দিতে ব্যর্থ বলে মামলার গুনাগুনের ভিত্তিতে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিষ্পত্তি করা হবে বলেও নোটিশে জানানো হয়েছিল।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বিমানের ওই ফ্লাইটে স্বর্ণ উদ্ধারের আগে বিমানটি যাত্রি নামানো শেষে হ্যাঙ্গারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেসময় শুল্ক গোয়েন্দারা হ্যাঙ্গারে নেওয়ার চেষ্টা বন্ধ করে তল্লাশি করতে বিমানের ভেতরে প্রবেশ করেন। দুইবার তল্লাশি করেও দৃশ্যমান স্থানে কোনও স্বর্ণ পাওয়া যায়নি। গোপন তথ্য থাকায় শুল্ক গোয়েন্দারা বিমানের বিভিন্ন টয়লেটে তল্লাশি চালান। টয়লেটের মিরর কেবিনেটের ভেতর টয়লেট টিস্যু রাখার প্যানেলের স্ক্রু খুলে সেখানে স্বর্ণ পান। এছাড়াও টয়লেটের বেসিনের নিচের চেম্বার খুলে ওয়াটার হিটারের কাছে ও একটি প্যানেল  খুলে স্বর্ণ পাওয়া যায়। একটি হোলের ভেতরে কার্গো হোল সংশ্লিষ্ট প্যানেল বরাবর প্রবেশ করানো কালো রঙ এর দড়িতে বাধা অবস্থায় দুটি খাতাতেও (কালো রংয়ের কাপড়ের মধ্যে সাদা রংয়ের সুতা দিয়ে সেলাই করা যা সাধারণত চোরাকারবারিরা খাতা নামে ডাকে) স্বর্ণ পাওয়া যায়।এছাড়াও একই বিমানের মাঝ বরাবর যাত্রীদের বসার স্থানে সর্বশেষ সিটের পেছনে রাখা লাইফ জ্যাকেট রাখার ক্যাবিনেটে ৩টি খাতার মধ্যেও স্বর্ণ পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা ৬২.৩৭ কেজি স্বর্ণ ও ৩৯৭ গ্রাম স্বর্ণালংকার উদ্ধার করেন।তবে এ ঘটনায় সম্পৃক্ত কাউকেই আটক করা যায়নি। শুল্ক গোয়েন্দারা স্বর্ণ উদ্ধারের পর বিমানটি জব্দ করেন।  এই স্বর্ণের মালিকের সন্ধানে ২০১৫ সালের মে মাসের ১২ তারিখে নোটিশ  বোর্ডে কারণ দর্শাও নোটিশ দিলেও কোনও ব্যক্তি স্বর্ণের মালিকানা দাবি করতে আসেনি।

এর বাইরে হয়তো বহন করার জন্য তিনিও কিছুটা আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন। মূলত অবৈধ উপায়ে স্বর্ণ ধরার ক্ষেত্রে ব্যাপক কড়াকড়ির কারণে চোরাচালানকারীরা এ পথটি বেছে নিচ্ছেন। কেউ হয়তো ৬০টি স্বর্ণের বার বাংলাদেশে প্রবেশ করাতে চাইছেন। তিনি এজন্য ৩০ জন যাত্রীকে দুটি করে বার দিয়ে দেবেন। এসব কাজে বিশ্বস্ত যাত্রীদের ব্যবহার করা হয়। পুরো কার্যক্রমে প্রযুক্তির সহায়তাও নেওয়া হয়। তারা বিমানবন্দরে এসে ঘোষণা দিয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় কর পরিশোধ করবে।

কিন্তু বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসার পর নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় এসব স্বর্ণ হাতবদল হয়ে যায়। এ সময় যিনি বহন করে আনছেন, তাকে চুক্তি অনুযায়ী আর্থিক ‘পুরস্কার’ দিয়ে দিচ্ছেন। ঐ কর্মকর্তা বলেন, দেখা গেছে অনেক যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে, যারা ঘন ঘন বিদেশে যাওয়া-আসা করছেন। আসার সময় দুটি করে বার নিয়ে এসে ঘোষণা দিয়ে সরকারকে কর পরিশোধ করছেন, যা অস্বাভাবিক। চোরাকারবারিরা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই এসব স্বর্ণ হাতবদল হতো। তবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা ধরার পর সতর্ক হয়ে যায় ।

এদিকে এসব স্বর্ণ কোথায় যায়, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলেও পুরো খাতে আইনি কাঠামো কিংবা নজরদারির মধ্যে না থাকায় এ খাতে এখনো শৃঙ্খলা ফেরানো যায়নি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে সরকার স্বর্ণ নীতিমালা পাশ করে। এই নীতিমালার আওতায় বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯ জন ডিলার স্বর্ণ আমদানির অনুমোদন নিয়েছেন। তারাও প্রতি ভরিতে ২ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করে স্বর্ণ আমদানি করতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস) জানিয়েছে, গত প্রায় দুই বছরে বাণিজ্যিকভাবে মাত্র দুই চালানে স্বর্ণ এসেছে ১৮ কেজি। বাজুস সূত্র জানায়, বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানিতে ভরি প্রতি ২ হাজার টাকা শুল্ককর ছাড়াও ব্যাংক চার্জ, বিমা খরচ, বিএসটিআই কর্তৃক মান পরীক্ষার চার্জসহ সব মিলিয়ে আরো দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ ব্যাগেজ রুলসের সুবিধা নিয়ে আনা স্বর্ণে ভরি প্রতি ২ হাজার টাকার বাইরে আর কোনো খরচ হচ্ছে না। অন্যদিকে আমদানির ক্ষেত্রে ভরি প্রতি খরচ পড়ছে সাড়ে তিন হাজার টাকা।

কিন্তু হঠাত্ করে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় এত বেশি পরিমাণ স্বর্ণ আসার কারণ কী? শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বর্ণ চোরাচালান ঠেকাতে বিভিন্ন পক্ষের ব্যাপক তত্পরতার কারণে ঐ পথকে এখন ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন চোরাকারবারিরা। ধরা খেলে সব স্বর্ণই চলে যাচ্ছে। আবার নিজেরাও থাকেন ঝুঁকির মধ্যে। এ কারণে ভরিপ্রতি ২ হাজার টাকা আর যাত্রীর খরচসহ কিছু বাড়তি টাকা গেলেও এই পথ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। 

ক্রাইম ডায়রি// ক্রাইম -অপরাধ জগত