চীনাদের মনোকষ্ট, আমাদের মনোকষ্ট

মুনতাসীর মামুন

চীনাদের মনোকষ্ট, আমাদের মনোকষ্ট

ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে চীনের প্রতি আমার কৌতুহল ও আগ্রহ অসীম। যৌবনে আমরা বলতাম নয়াচীন। বঙ্গবন্ধু চীনে গেলেন দুইবার- ১৯৫২ ও ১৯৫৬ সালে। প্রথমবার চীন মাত্র শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছে। চীনকে তিনিও ভালোবেসেছিলেন। বই লিখেছেন নয়াচীন নাম দিয়ে। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ এই দুই দশক চীন, মাও সে তুং ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধার। অনেক রাজনৈতিক দলের তো শ্লোগানই ছিল, চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। ১৯৭১ সালে সেই ভালোবাসাটা চোট খেল। এরপর মানজালার (বাংলাদেশ) হয়ে গেছি কয়েকবার। যতবারই গেছি ততবারই অবাক হয়েছি। সেখানকার মানুষের কর্মক্ষমতা আর শৃঙ্খলা দেখে। রাতারাতি পৃথিবীর আর কোনো দেশ নিজেকে এত বদলে ফেলতে পারেনি। তবে ইতিহাস বলে, চীনের কাছাকাছি গেলে চোট খেতে হয়। নেহেরুর সময় শ্লোগান ছিল- হিন্দি-চীনি ভাই ভাই। এখন দেখুন অবস্থা। বঙ্গবন্ধুও চোট পেয়েছিলেন। আমরা তো বটেই, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের জেনারেশন।

গত কয়েকমাস আমাদের শ্রদ্ধেয় বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক চীন নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন যার যৌক্তিকতা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিচারপতি চৌধুরী আমাকেও বলেছিলেন, রোহিঙ্গা ও উইঘুর নিয়ে লিখতে। লিখতে পারিনি। কিন্তু আজ একটি প্রতিবেদন দেখে মনে হলো দু’এক কথা লিখি। ভোরের কাগজে প্রথম পৃষ্ঠায় একটি শিরোনাম- ‘তাইওয়ানের উপহারে মনোকষ্টে চীন: মিডিয়াকে দুষলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।’ (৩.৯.২০২০)

বিষয়টি হলো ৩১ অগাস্ট তাইওয়ানের একটি কোম্পানি থেকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কিছু সামগ্রী দেওয়া হয় এখানকার একটি কোম্পানিকে। অনুষ্ঠানে কয়েকজন মন্ত্রী ও সচিব ছিলেন। খবরটি পত্রিকায় প্রকাশের পর চীনা দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মৌখিকভাবে তাদের মনোকষ্টের কথা জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভোরের কাগজের প্রতিবেদককে জানান, “এ ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই চীন দুঃখ পেয়েছে। পুরো বিষয়টি সাজিয়েছে মিডিয়া। তবে মিডিয়া বিষয়টিকে নিয়ে ফলাও করে প্রচার করেছে। বাংলাদেশ এক চীন নীতিতে বিশ্বাস করে। এখানে তাইওয়ানের সঙ্গে আলাদা আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের কোনো বিষয় নেই। দূতাবাসকে আমরা বিষয়টি জানিয়েছি।”

ছোট একটা দ্বীপের করোনাভাইরাস প্রতিরোধক উপহার দেওয়াতে কষ্ট পেয়েছে চীন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা যে কর্মকর্তাকে চীনা দূতাবাসের কর্মকর্তা ফোন করে মনোকষ্টের কথা জানিয়েছেন, তাকে আমাদের মনের কষ্ট বা কষ্টগুলি জানিয়ে দিলে হতো না।

আমাদের মুখপাত্র বলতে পারতেন (অবশ্য তার তখন জন্ম হয়নি), ব্রাদার (ব্রাদারেরও জন্ম হয়নি) আমাদের বাপ-চাচারা প্রায় ১৯৭১ সালের মনোকষ্টের কথা বলেন। ওই সময় পাকিস্তান যখন বাঙালিদের জবাই করছে, মা-বোন-কন্যাদের গণিমতের মাল মনে করছে, তখন কি চীনারা হাততালি দেয়নি? যাক সে কথা, যারা চীনা রাজনীতিকে আদর্শ মনে করতেন, তাদেরকেও কি বিব্রত করেনি চীন? এই যে আমাদের মওলানা ভাসানী যিনি আওয়ামী লীগ করেছেন, গণআন্দোলন করেছেন, চীনাভক্ত বলে আইয়ুব খানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন- তাকেও কী অপদস্থই না করল চীন! মওলানা তাদের জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানকে বিরত রাখার জন্য। কিন্তু নৈব: নৈব: চ। মওলানা সাহেব তখন মনোকষ্টে বলেছিলেন, “এত শুনে এত দেখেও যদি এদের বিবেক জাগ্রত না হয় তাহলে কি আমি গিয়ে বলে ওদের বিবেক জাগ্রত করতে পারব?” (আনন্দ বাজার, ৩১.৫.১৯৭১)

আমাদের কর্মকর্তা বলতে পারতেন, ব্রাদার আপনার দুঃখ আমি বুঝি। কিন্তু দেখেন স্বয়ং আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি মনোকষ্টে ভোগেননি যখন ১৯৭১ সালে আপনাদের মহান নেতা চৌ এন লাই বলেছিলেন- “ভারতের ষড়যন্ত্রমূলক ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমরা পাকিস্তানকে দৃঢ়ভাবে সহায়তা করব।” (হেরাল্ড টিব্রিউন, ১.১২.’৭১)

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলতে পারতেন, চীনা রাষ্ট্রদূতকে- কমরেড, মুজিববর্ষ চলছে। এ সময় বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে। কমরেড, আপনি জানেন না আমাদের জাতির পিতা আপনাদের মহান নেতা মাও সে তুং ও চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি চীনকে এত ভালোবাসতেন যে, আমার দেখা নয়াচীন নামে একটি বইও লিখে ফেলেছিলেন যা এখন বাজারে পাওয়া যাবে, আপনারা সেটা চীনা ভাষায় অনুবাদ করতে পারেন। যা হোক, কমরেড, বঙ্গবন্ধু তখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ছেন। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন। চীনের আদর্শ তার মনে ছিল। এই সময় একদিন বাংলা একাডেমি থেকে কবীর চৌধুরী, শামসুজ্জামান ও আরো কয়েকজন গেলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। লিখেছেন শামসুজ্জামান খান, একজন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে তো চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। বঙ্গবন্ধু বললেন, “দুটো বিষয়তো আলাদা। মাও একজন বড় নেতা। জীবনে বহু সংগ্রাম করেছেন, তার জীবন ও চিন্তাটা জানা ও বোঝা দরকার। একটা অনুন্নত বিশাল দেশকে তিনি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সে দেশটায় এত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কত উন্নত হয়েছে। এই ব্যাপারটা কীভাবে ঘটেছে তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি।” হঠাৎ তার মুখে বেদনার ছায়া পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “রাজনীতি বড় জটিল, নিষ্ঠুর। এর ফলে কত অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। তা না হলে চীনের আমাদের সমর্থন না করার ক্ষেত্রে কোন যুক্তিই নেই। চীন খুব অন্যায় কাজ করেছে।” কমরেড, আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী, হাত-পা বাঁধা, দেশেও ছিলাম না বহুদিন, তারপরও কমরেড যখন এই কথা মনে পড়ে বুক ঠেইল্যা কান্দন আইয়ে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে না থেকে বলতে পারতেন, কমরেড, তাইওয়ান কয়েকটা মাস্ক দিয়েছে দেখে আপনি এত কষ্ট পেলেন! আমাদের ৫০ গুণ বড় একটা দেশ এত কষ্ট পেল, কিন্তু কমরেড, মুজিববর্ষ তো, বাংলাদেশের গোল্ডেন জুবিলি তো ১৯৭১-৭৫ এর কথা মনে পড়বেই। কমরেড, বঙ্গবন্ধু এত ভক্ত ছিলেন আপনাদের। অথচ আপনারা মানজালা (বাংলাদেশ)-কে একটা স্বীকৃতি দিলেন না পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকতে। আপনাদের সামন্ত রাষ্ট্র (অনেকের মতে, আমরা বলি না) ওই যে, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন খেলোয়াড়, সে দেশ পর্যন্ত স্বীকৃতি দিয়েছিল। কমরেড, স্বীকৃতি দিলেন বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পর। মানতে বড় কষ্ট হয় হে কমরেড! এমন প্রতিরোধ স্পৃহা আপনাদের? (জনান্তিকে বলে রাখি, আমি ইতিহাসের ছাত্র এটা জানি, অন্যরা জানেন না)।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলতে পারতেন, ব্রাদার, জাতির পিতাকে অনেক অপমান করেছেন। তার কন্যাকেও তাই বলে করবেন? এটা মানতে বড় কষ্ট হে ব্রাদার। তিনি আমাদের বস। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কী খেলা খেলছেন। খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। ব্রাদার, কথা বলতাম না, নেহায়েত দুটো টাকা পয়সা দিচ্ছেন তাই বলছি।

আমাদের কর্মকর্তা আরো বলতে পারতেন, বিবিসি থেকে শুরু করে সব টিভি যে উইঘুরদের নিয়ে আপনাদের এক্সপেরিমেন্ট দেখাচ্ছে সেটাকে সত্যি? আমাদের মোছলমানরা যে কী জিনিস! চীনে এত মুসলমানকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে কিন্তু কিছু মনে করে না, তাদের গুরু সৌদি থেকে আমিরাত সব ইসরায়েলকে ‘ভ্রাত’ বলছে, কিছু হয় না, কিন্তু ভারতে কেউ মুসলমানদের কিছু বললেই ‘ভারতের দালাল শেখ হাসিনাকে সরাতে হবে, সরাতে হবে’ এই শ্লোগানে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেয়। চৌ এন লাই এ রকম ‘জাতীয়তাবাদীদেরই’ প্রশংসা করেছিলেন ১৯৭১ সালে।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনেক সময় অনেক ভালো ভালো আমাদের মনের কথা বলেন। কিন্তু, চীনা রাষ্ট্রদূত যখন ১৫ অগাস্ট খালেদা জিয়ার ‘জন্মদিন’-এ তাকে সালাম করতে গেলেন কেকসহ তখন তিনি কষ্ট পেলেন না? তিনি তো চীনা রাষ্ট্রদূতকে ফোন করে বলতে পারতেন, কমরেড ব্রাদার বড় কষ্ট পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর শহীদের দিনটিকে এই মহিলা জন্মদিন হিসেবে (পরে) বেছে নিয়েছিলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেও তার পিতার মতো নিকেশ করতে চেয়েছেন, তাকে ঐদিন সালাম করার মানে তো বঙ্গবন্ধুর খুন যৌক্তিক, শেখ হাসিনাকে খুন করা যৌক্তিক- তার স্বীকৃতি দেওয়া। কমরেড, আপনারা এখন আমাদের কাছের বন্ধু, আমরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করছি প্রেমিক প্রেমিকার মতো, যে আলিঙ্গন দেখে নরেন্দ্র মোদী দিশেহারা, ভিলেনের মতো অবস্থা, সেখানে এভাবে ছুরি মারলেন! আবারও শুধু বঙ্গবন্ধু বা তার কন্যাকে নয়, পুরো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনকে ছুরি মারা! কমরেড, আপনি কি আপনার পাকিস্তানি বন্ধুদের কাছে গ্রেট সিঙ্গার নূরজাহানের কথা শোনেনেনি, যিনি গেয়েছিলেন- ‘দিন দিলইতো হ্যায়, পাত্থর তো নেহি।’

কমরেড, কয়েকটা মাস্কের জন এতকষ্ট পেলেন কিন্তু একটা জাতির মনোকষ্ট দেখলেন না!

ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে বলি, চীন তার আদর্শে সব সময় অটল থেকেছে। উদাহরণ, ১৯৭১ সালে চীন গণহত্যাকারীদের সমর্থন করেছে (চীন ১৯৪৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কদাচিৎ মুক্তিকামী মানুষদের সমর্থন করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সব সময় মুক্তিকামী মানুষদের সমর্থন করেছে।)

১৯৭৫ সালে চীন হত্যাকারীদের সমর্থন করেছে। চীন রোহিঙ্গা গণহত্যা সমর্থন করেছে এবং তারা যেন মিয়ানমারে না ফেরে সে জন্য মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে। চীন শেখ হাসিনার শুধু নয়, ১৯৭১ এর হত্যাকারীদের সমর্থক খালেদা জিয়াকে সমর্থন করেছে। তারা তাদের নীতি থেকে টলেনি।

আমরা টলেছি। আমরা হত্যাকারী রাষ্ট্র ও তাদের ল্যাঙ্গটদের এ দেশে রাজনীতি করতে দিয়ে স্বীকৃতি দিয়েছি। চীনকে ভালোবেসেছি, ইসরায়েলের সমর্থক আরব রাষ্ট্রদের করুণা ভিক্ষা করছি। গণহত্যাকারীদের সোচ্চার সমর্থক (১৯৭১) আমেরিকার আর্শীবাদের জন্য ছটফট করছি। কী করা, গরিবের সুন্দরী বউয়ের মতো দশা আমাদের। সবাই বাহুলগ্ন করতে চায়। ছোট দেশ হলে সবাই মনে করে লেজ নাড়বে না কেন সে?

মুনতাসীর মামুন লেখক ও গবেষক